Monday, January 19, 2015

সহিংস হয়ে উঠছে অবরোধ:যুগান্তর

বিএনপি-জামায়াতের টানা অবরোধ কর্মসূচিতে সহিংসতা ক্রমশ বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সহিংস ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের অধিকাংশই নিরীহ মানুষ। নিহতদের মধ্যে ১২ জন পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে নৃশংসভাবে মারা গেছেন। সংঘর্ষে ১০ ও অন্যান্য ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু হয়। অসংখ্য মানুষ ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন। ৬ জানুয়ারি
থেকে শুরু হওয়া এ অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে যানবাহনে পেট্রলবোমা-অগ্নিসংযোগ আর ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে ৫৩৭টি। বিভিন্ন স্থানে রেলের ওপর ১০ বার নাশকতামূলক হামলা হয়। এসব ঘটনায় সাংবাদিক, পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ আহত হয়েছেন সাত শতাধিক মানুষ। মামলা হয়েছে সাড়ে ৩শ’। আসামি করা হয়েছে ২৫ হাজার ব্যক্তিকে। গ্রেফতার ও আটক করা হয়েছে ৩ হাজার ১শ’ ব্যক্তিকে। দুই সপ্তাহজুড়ে টানা অবরোধে অগ্নিসংযোগ, ককটেল-পেট্রলবোমা বিস্ফোরণ, রেলে নাশকতা, মামলা-হামলা ও গ্রেফতার, হয়রানির সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ এখন পেট্রলবোমার আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তির দিনটিকে বিএনপি গণতন্ত্র হত্যাদিবস আখ্যা দিয়ে জনসভার কর্মসূচি দেয়। কিন্তু পুলিশ ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করায় বিএনপি লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। আজ সেই কর্মসূচির ১৪তম দিন। এরপর শুরু হয় গণগ্রেফতার অভিযান। গ্রেফতার হন বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীসহ ৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মী। অবরোধের নামে পুলিশ সাধারণ মানুষকেও গ্রেফতারের নামে হয়রানি করছে। চলছে পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যও। সহিংস ঘটনা দিন দিন বাড়তে থাকায় পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা হার্ডলাইনে অবস্থান নিয়েছে। ইতিমধ্যে সারা দেশে যৌথবাহিনী নামানো হয়েছে। এই অভিযানের অংশ হিসেবে শনিবার রাত ১টা থেকে রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মোবাইলের ভাইবার ও ট্যাঙ্গো সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে যৌথ বাহিনীর অভিযানের তথ্য যাতে সন্ত্রাসী ও সহিংসতাকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য এ সিদ্ধান্ত। ভাইবার বন্ধ রাখলেও মোবাইল টেলিফোনসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ অব্যাহত আছে। শনিবার বিটিআরসির সহকারী পরিচালক তৌসিফ শাহরিয়ার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেশের ৩৭টি আইআইজিকে (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) ভাইবার ও ট্যাঙ্গো সার্ভিস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে- মোবাইল, টিঅ্যান্ডটি ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ খোলা থাকলেও সেগুলোর ওপর কড়া নজরদারি চলছে। আড়িপাতা হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল ও টিঅ্যান্ডটি ফোনে। এছাড়া প্রতিমাসে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোতে তালিকা দিয়ে ওইসব ফোনের ভয়েস রেকর্ড, ডাটা নেয়া হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবরোধে সহিংসতায় এ পর্যন্ত যেসব মানুষের প্রাণহানি এবং অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন তাদের অধিকাংশই সাধারণ ও নিরীহ মানুষ। সবাই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার বলি। কিন্তু তারা কেউই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। গত ১৪ দিনের অবরোধে সারা দেশে এখন পর্যন্ত যে ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, তাদের ১৯ জনই সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়েই মারা গেছেন নারী-শিশুসহ পাঁচজন। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ১৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। অবরোধ কর্মসূচিতে আহত হয়েছেন ৭ শতাধিক ব্যক্তি। যাদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। শনিবার রাতে বরিশালের উজিরপুরে চলন্ত ট্রাকে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমার আগুনে সোহাগ (১৮) নামে ট্রাকের এক হেলপার দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ঘটনায় ট্রাকচালক রিপন দগ্ধ হয়েছেন। মৎস্য ভবনের কাছে পুলিশের বাসে নিক্ষেপ করা হয় পেট্রলবোমা। এতে দগ্ধ হয়েছেন দুই পুলিশ ও আহত হয়েছেন ১১ জন। নগরীতে পুলিশের বাসসহ কমপক্ষে ১১ গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। ওইদিন মোহাম্মপুর বেড়িবাঁধে ঢাকা উদ্যানের কাছে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমায় নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ ৭ জন দগ্ধ ও ২ জন আহত হয়েছেন। গুলিস্তানে জয়পাড়া পরিবহন নামে একটি বাসে আগুন দেয়ার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন আকরাম হোসেন নামে বাংলা কলেজের এক ছাত্র। মিরপুরে গাড়িতে আগুন দেয়ায় এক যুবককে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে। গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের কাছে একটি চলন্ত বাসে আগুন দেয়ার সময় পেট্রলবোমাসহ এক পিকেটারকে আটক করেছে পুলিশ। রায়েরবাগে অবরোধ সমর্থকদের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুলতানা ইসলাম দীবা। ঢামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, মৎস্য ভবনের কাছে পেট্রলবোমায় আহত কনস্টেবল শামীম আহমেদ মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন এবং তার শরীরের দুই শতাংশ ঝলসে গেছে। রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। পেট্রলবোমায় বাসটির চালক পুলিশ কনস্টেবল মোর্শেদের মুখ, হাত ও বুকসহ শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। আহত পুলিশ সদস্যকে দেখতে প্রধানমন্ত্রী স্কয়ার হাসপাতালে যান। দশম সংসদ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে আবার রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়েছে বছরের শুরু থেকে। এ সহিংসতায় আবারও সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটেছে ১৩ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন- কুড়িগ্রামের রহিমা বেগম, তার ছেলে রহিম বাদশা ও মেয়ে জেসমিন আক্তার এবং রংপুরের তছিরন বেগম ও ২ বছরের এক শিশু। নিহত রহিম বাদশার স্ত্রী নিলুফার বেগম জানান তার স্বামী ঢাকায় বাদাম বিক্রি করতেন। এটা দিয়ে তাদের সংসার চলত। ৮ জানুয়ারি ঢাকার ইস্কাটনে অবরোধকারীদের পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন প্রাইভেটকার চালক আবুল কালাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৫ জানুয়ারি মারা যান ২৬ বছরের এই তরুণ। ১২ জানুয়ারি অবরোধের কারণে বাস না পেয়ে ট্রাকে করে ফেনী থেকে চট্টগ্রাম ফিরছিলেন রিয়াজউদ্দিন বাজারের দোকান কর্মচারী এনাম হোসেন। পথে জোরারগঞ্জে দুর্বৃত্তদের পেট্রলবোমা হামলায় নিহত হন তিনি। একই দিন অবরোধকারীদের ধাওয়ায় নিহত হন চালক জমির হোসেন। ১৫ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে বাসের ভেতর পুড়ে মারা যান চালকের সহযোগী তোফাজ্জল হোসেন। ১১ জানুয়ারি রাতে গাইবান্ধায় যাত্রীবাহী বাসে দুর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করলে আসাদুল মিয়া নামে এক যাত্রীর শরীরে আগুন ধরে যায়। এটি দেখে ভয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে মাটিতে পড়ে নিহত হন পারভেজ মিয়া। ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের গণতন্ত্র হত্যা দিবস ও আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র রক্ষা দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে নাটোর, চঁাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে প্রাণ গেছে চারজনের। তারা সবাই বিএনপির নেতাকর্মী বলে দাবি করা হয়েছে। নাটোর শহরে বিএনপির মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় প্রাণ হারান রাকিব মুন্সী ও রায়হান আলী। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করতে গেলে ২০ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এতে প্রাণ হারান জামসেদ আলী। এদিন সারা দেশে আহত হয়েছেন ২ শতাধিক। আর গ্রেফতার ও আটক করা হয়েছে ৪০০ জনকে। রাজশাহীর পুঠিয়ার বানেশ্বরে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান মজির উদ্দিন। এ ঘটনায় সংবাদকর্মীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। একইদিনে ফেনীতে ককটেল বিস্ফোরণে ঝলসে যায় দুই স্কুলছাত্র। অবরোধের আগেরদিন চট্টগ্রামে পুলিশের গুলিতে ২০ দলীয় জোটের সভা পণ্ড হয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে জোটের সংঘর্ষে পুলিশের তিন সদস্যসহ ১৫ জন আহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের অভিযানে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরীসহ দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয় চট্টগ্রাম থেকে। অবরোধের দ্বিতীয় দিনে ৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালীতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান মহসিন ও রুবেল। বিএনপি দাবি করেছে এ দুজন তাদের কর্মী। ওইদিন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় মারা গেছেন ইসমাইল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। অবরোধের তৃতীয় দিন ৮ জানুযারি রেললাইনে চলে ভয়াবহ নাশকতা। ওইদিন জয়পুরহাটে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় লাইনচ্যুত হয়ে ২৫ যাত্রী আহত হন। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে রাতে অবরোধকারীদের ধাওয়ায় দুর্ঘটনার শিকারে প্রাণ হারান মোটরসাইকেল আরোহী যুবক ইউসুফ। বিভিন্ন স্থানে রেললাইনে নাশকতার কারণে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। অনির্দিষ্টকালের অবরোধের চতুর্থ দিনে শুক্রবার ঢাকার বনানীতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসায় হাতবোমা নিক্ষেপ, গুলশানের বারিধারায় কানাডিয়ান ও সৌদি দূতাবাসের সামনে একের পর এক ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ফেনীতে হামলা করা হয় ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতেও। মগবাজারে প্রাইভেটকার ও মোহাম্মদপুরে পেট্রল দেয়ার ঘটনায় দগ্ধ হন তিনজন। অবরোধের প্রথমদিন ঢাকার দনিয়া শ্রমিক লীগ কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়। বংশালে বিএনপি অফিসে দেয়া হয় আগুন। নয়াপল্টনে কালভার্ট রোডে পুলিশের ১টি মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পল্টনে পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের গোলাগুলিতে ৬ জন আহত ও ১১ জন গ্রেফতার হন। সেগুনবাগিচায় ছাত্রদল মিছিল বের করলে ২টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। শাহজাহানপুরে পুলিশের গুলিতে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার হারুনসহ ১২ জন গুলিবিদ্ধ হন। মিরপুরে পূরবী সিনেমা হলের সামনে একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেয়া হয়। উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হয়।  

No comments:

Post a Comment