Tuesday, January 20, 2015

অবরোধের খাঁড়ায় ধুঁকছে কক্সবাজারের পর্যটনপল্লী:কালের কন্ঠ

বড্ড কষ্টে আছেন বিজন কান্তি দে। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে তাঁর বড় মেয়ে বৃষ্টি রানী দের লেখাপড়ার এখন কী হবে- এমন ভাবনায় তিনি কাতর। মেয়েটি সেখানে নার্সিংয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে দুই বছর শেষ হয়েছে। এ জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের শিক্ষাঋণ নিয়েছেন তিনি। প্রতি মাসেই ব্যাংকে তাঁকে পরিশোধ করতে হয় ১০ হাজার টাকার কিস্তি। মাসের কিস্তি মাসেই শোধ করতে হয়। কিন্তু গত মাসের কিস্তির টাকা এখনো তিনি দিতে পারেননি। আবার একই সঙ্গে দুই
মাসের টাকা তিনি কিভাবে দেবেন। এর ওপর আরো দুই সন্তানসহ স্ত্রী নিয়ে সংসারের খরচ- এসব চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে ৫০ বছর বয়সী বিজনের। বিজন পেশায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের চিত্রগ্রাহক। তিনি পর্যটকের ছবি তুলে জীবন ধারণ করেন। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শান্তিরহাটের বাসিন্দা বিজন টানা সাত বছর ধরে কক্সবাজার সৈকতে এ পেশায় রয়েছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সৈকতের বালিয়াড়িতে ঘুরে ঘুরে পর্যটকের ছবি তোলেন। কোনো সময় বেশি রোজগার হয়, আবার কোনো সময় কম হয়। গত ১৫ দিনের টানা অবরোধের ১২ দিনই বিজনের আয়ের খাতা শূন্য রয়েছে। টানা অবরোধের কারণে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজারের সৈকত পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ায় চিত্রগ্রাহক বিজনের এমন করুণ অবস্থা হয়েছে। কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টে পর্যটন চেয়ারে বসে গতকাল সোমবার বিজন অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত বর্ষার সময়েও অনেক পর্যটক এসেছিল সৈকতে বেড়াতে। আর এখন পর্যটক আসার মৌসুম। প্রতিদিনই হাজারের বেশি টাকা রোজগার হয় এমন সময়ে। কিন্তু দুঃখের কথা, গত ১২ দিনে আমার এক আনা পয়সাও রোজগার হয়নি। ঘর ভাড়াও বকেয়া। মেয়েটির লেখাপড়ার ব্যাংক ঋণের টাকা কিভাবে জোগাড় করব- ভেবে কূল পাচ্ছি না।' দেশে চলমান অবরোধ নিয়ে বিজনের তেমন কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি বলেন, 'কেউ যদি না বুঝে এ রকম কর্মসূচি দিত, তাহলে ক্ষোভ প্রকাশের জায়গা থাকত। কিন্তু সব কিছু তো বুঝেশুনেই করা হচ্ছে। আমার মতো পোড়া কপাল্যাদের পোড়ার জন্যই এসব করা হচ্ছে।' তিনি আরো বলেন, 'চলমান অবরোধের কারণে একদিকে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মানুষ মরছে, অন্যদিকে আমরাও পর্যটকশূন্য সৈকতের কারণে মরে যাচ্ছি।' কক্সবাজার সৈকতে চিত্রগ্রাহক সমিতির নেতা হেলাল জানান, সৈকতে প্রায় ৩০০ তরুণ পর্যটকদের ছবি তুলে জীবন ধারণ করেন। এসব চিত্রগ্রাহকের অনেকেই স্টুডিওর মাসিক বেতনভুক্ত। আর অন্যরা নিজেদের ক্যামেরা নিয়ে পর্যটকের ছবি তুলে দিয়ে আয় করেন। এসব চিত্রগ্রাহক এখন পর্যটকের অভাবে সীমাহীন অর্থ সংকটে রয়েছেন। তাঁদেরই একজন বাবলু (২৫)। নিলফামারীর বাসিন্দা বাবলু এবারের পর্যটন মৌসুম সামনে নিয়ে তিন মাস আগে বিয়ে করেছেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন- এ মৌসুমে বেশি পর্যটকের আগমন হবে। তাই আয়-রোজগার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম থেকে স্ত্রীকেও এখানে নিয়ে আসবেন। কিন্তু অবরোধে তাঁর সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। পর্যটকের অভাবে কক্সবাজারের চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউস এবং রেস্টুরেন্ট এখন মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। হোটেল-রেস্টুুরেন্ট মালিক সমিতির সভাপতি ওমর সুলতান বলেন, '২০১৩ সালের মতো এবারও হোটেল-মোটেলে কর্মচারী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। আবার অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে টানা অবরোধের কারণে দুই শতাধিক পর্যটক গাইড, সৈকতের তিন শতাধিক পর্যটন চেয়ারের মালিক, কয়েক শ হকার ও পাঁচ শতাধিক দোকানের মালিকসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দুর্দিন চলছে। গতকাল সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন পর্যটন চেয়ার ব্যবসায়ী রহিম। তিনি জানান, অবরোধের আগে তাঁর ৩০টি চেয়ার নিয়ে দৈনিক হাজার দেড়েক টাকা আয় করে সাত-আটজন কর্মচারীর বেতন দিয়েছেন। আর গতকাল তাঁর আয় হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা। কক্সবাজার সৈকতে কর্মরত সি সেইভ লাইফ গার্ডের দৈনন্দিন রেকর্ড করা তথ্যে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সৈকতে হাজার হাজার পর্যটক বেড়াতে এলেও পরে এ সংখ্যা উদ্বেগজনকহারে কমেছে। সৈকতের বর্তমান চিত্র তুলে ধরে লাইফ গার্ডের ইনচার্জ আবদুস শুকুর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সৈকতের লাবণী পয়েন্টের সুইমিং জোন ঘোষিত সৈকতে ২ জানুয়ারি বিকেলে গোসল করেছে তিন হাজার ৫০০ পর্যটক। আর গতকাল একই স্থানে গোসল করেছে মাত্র ১২০ জন পর্যটক।'      

No comments:

Post a Comment