স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তব অবয়ব পাচ্ছে। নদীর স্রোতের মতোই দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে চলছে এর নির্মাণকাজ। ছয় বছর আগে অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ
কম-বেশি ৩৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এর সিংহ ভাগ কাজই হয়েছে গত এক বছরে। আর টাকার অঙ্কে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া মূল সেতুর নির্মাণকাজও এগিয়ে চলছে। সেতু নির্মাণের এই অগ্রগতি অর্জন হয়েছে প্রকল্পটি থেকে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পর। প্রকল্প থেকে সংস্থাটি নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বড় এই নির্মাণ অবকাঠামো বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস এরিয়া ও মূল সেতু নির্মাণ ও নদীশাসনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালের জুন মাসে সেতু উন্মুক্তকরণের লক্ষ্যে প্রণীত সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ধরেই এগিয়ে চলছে সব কাজ। সেতু নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতির এসব তথ্য গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত 'ফাস্ট ট্র্যাক' প্রকল্প-সংক্রান্ত বৈঠকে উঠে এসেছে। বৈঠকে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও অর্জিত ফলাফলের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল কাজগুলো একের পর এক শুরু হয় ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে। ওই সময় শুরু হওয়া জাজিরা সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে ৩০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। একই সময়ে শুরু হওয়া জাজিরা সংযোগ সড়ক, মাওয়া সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া-২-এর নির্মাণকাজ তদারকি কার্যক্রম ২২ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পের মাওয়া সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় এর নির্মাণকাজ ২২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এ সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ শেষ হবে। দুটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও সার্ভিস এরিয়া-২ নির্মাণকাজ তদারকিতে মোট ৯ হাজার ২২২ শ্রম মাস দরকার হবে। অর্থাৎ ৯ হাজার ২২২ জন শ্রমিক একসঙ্গে এক মাসে যে পরিমাণ কাজ করতে পারে, এ ক্ষেত্রেও ওই পরিমাণ কাজ হবে। গত বছরের জানুয়ারিতে শুরুর পর এ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে সার্ভিস এরিয়া-২ নির্মাণ কার্যক্রম। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এ কাজ শেষ হবে। এ ছাড়া ২০১১ সালের জুন মাসে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা পরিবেশ সুরক্ষা কার্যক্রম। ইতিমধ্যে এর ১৫ শতাংশ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া নদীশাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আসছে। গত নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে মূল সেতু নির্মাণ ও নদীশাসন কার্যক্রম তদারকির কাজও। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এ ধরনের বৃহৎ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অন্যান্য অংশ বাস্তবায়ন পরিস্থিতির পরই সাধারণত মূল সেতু নির্মাণকাজ শুরু হয়। পদ্মার ক্ষেত্রেও তেমনটিই হয়েছে। চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানির সঙ্গে চুক্তির পর গত জুলাই মাসে মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। মূলত চীনসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নির্মাণ উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আনার মধ্য দিয়ে এ কাজ শুরু হয়। সঙ্গে চলছে সেতুর পিলার বসানোর জন্য মাটি পরীক্ষার কাজও। মূল সেতু নির্মাণের এসব কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে এর ১ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করছে সরকার। ২০১৮ সালের জুন মাসে মূল সেতু নির্মাণ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সম্পর্কে সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানান, আগামী ছয় মাস পর মূল সেতুর নির্মাণ কাজে আশানুরূপ অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। নদীশাসন কার্যক্রম চলমান রয়েছে উল্লেখ করে সেতু বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নদীশাসন কাজের নকশা অনুযায়ী ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে ব্যাপক ড্রেজিংয়ের দরকার হবে। আর মূল সেতুর কাজে ব্যবহৃত ফ্লোটিং ক্রেন চলাচলের জন্য নদীর চর এলাকায় দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে নাব্যতা চ্যানেল খনন প্রয়োজন হবে। এ জন্য আনুমানিক ছয় কোটি ঘনমিটার বালি ড্রেজিং করতে হবে। এসব বালি নদীর চর এলাকার খাসজমি ও সমাপ্ত হওয়া নদীশাসন এলাকায় রাখা যাবে, যা পরে বনায়ন বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া এসব বালি কাঁঠালবাড়ী থেকে মাঝিকান্দি পর্যন্ত আংশিক চালু চ্যানেলটি ভরাট করে জমি উদ্ধার করা যেতে পারে। এ ছাড়া ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ ৯৯ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি মাত্র ১ শতাংশ আগামী জুন মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে। ইতিমধ্যে পুনর্বাসন কার্যক্রম ৬৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ সম্পন্ন হবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫৬১ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য আট হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে দুই কিস্তিতে এক হাজার ১৫৬ কোটি ২০ লাখ টাকা ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এটি এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। দ্রুতগতিতে এ সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। ২০১৮ সালেই সেতুটি সড়ক ও রেল যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
No comments:
Post a Comment