Thursday, January 8, 2015

শিথিল অবরোধে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মানুষ:কালের কন্ঠ

অবরোধের প্রথম দিন মঙ্গলবার ছয়টি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে, তার পরও গতকাল বুধবার রাজধানী ছিল তুমুল কর্মব্যস্ত। প্রধান সড়কগুলোতে ছিল যানজট। আতঙ্ক থাকলেও রাস্তায় বেরিয়েছিল কর্মব
্যস্ত মানুষ। তাদের কারো গন্তব্য ছিল সরকারি-বেসরকারি অফিস, কেউ বেরিয়েছিল নিজের ব্যবসা সামলাতে। স্কুল খোলা, তাই শিশুরাও বের হয়েছিল উৎকণ্ঠিত মা-বাবার সঙ্গে। গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন বা গণতন্ত্র হত্যার প্রতিবাদ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সাধারণ মানুষের। জীবন চালানো, জীবিকার সন্ধানই এখন তাদের মূল চ্যালেঞ্জ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধের ডাক দেওয়ার পরেও মাঠে নেই তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা। গত দুই দিনে দেশের কোথাও তেমন কোনো শোডাউন দেখাতে পারেনি দলটি। রাজশাহী ও চাঁপাইয়ে শিবিরের সহিংসতা আর নোয়াখালী, নাটোর, চট্টগ্রামে বিএনপির মরিয়া চেষ্টা ছাড়া সারা দেশ মোটামুটি শান্ত। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অনৈক্য, সরকারের সঙ্গে বড় নেতাদের অনেকের গোপন আঁতাত, পুলিশের তাড়া আর গ্রেপ্তারের ভয়ে আন্দোলনই জমাতে পারছে না বিএনপি। ২০১৩ সালের নজিরবিহীন সহিংসতার মধ্যেও রাজধানী ছিল কর্মব্যস্ত। একদিকে সহিংসতা হয়েছে; অন্যদিকে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত চলেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সহিংসতা অনেকাংশে কমেছে। হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি হয়েছে আরো ‘ভোঁতা’। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বলছে, ওই নির্বাচন তাদের কাছেও প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু তাই বলে তারা নিজের জীবন, জীবিকা হারাতে চায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে হয়তো ঘোর আপত্তি আছে, তাই বলে তারা আরেকটি ২০১৩ সাল চায় না।’ বহুল ব্যবহারে হরতাল-অবরোধের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচিও এখন মামুলি হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধকে জনগণ প্রচণ্ডভাবে ‘ইগনোর’ (এড়িয়ে যাওয়া) করতে শুরু করেছে। একজন কর্মজীবীর একটা দিন লোকসান হওয়া সাংঘাতিক ব্যাপার। আজকে যদি ঘোষণা দেওয়া হয় যে গাড়িতে বোমা মারা হবে না, ভাঙচুর হবে না, তাহলে হরতাল পালিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। রাজনীতিতে হরতালের তুলনায় অবরোধের বয়স কম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী গুজরাটি শব্দ হরতাল প্রবর্তন করেন। রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল ডেকে তা পালনের আহ্বান জানাবে, জনগণ স্বপ্রণোদিত হয়ে তা পালন করবে- এটাই হরতালের সারকথা। অবরোধ একটু আলাদা- এখানে জনগণকে আহ্বান নয়, বরং জোর করে পালন করানো হয়। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ‘তমুদ্দিন মজলিস’ প্রথম হরতাল ডাকার পর বাংলাদেশে প্রচুর হরতাল হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গড়ে ৪৬ দিন হরতাল  দেখেছে দেশবাসী। কিন্তু সাম্প্রতিক যেসব হরতাল হয়েছে তাতে মানুষের সাড়া তো ছিলই না, উল্টো আগের দিন গাড়ি পুড়িয়ে, বোমা মেরেও পরের দিন রাস্তায় যানজট ঠেকানো যায়নি। ২০১৪ সালে দেশে ২২টি হরতাল ডাকা হয়েছে, এর মধ্যে সাতটি ডেকেছে বিএনপির নেতৃত্বে থাকা ২০ দলীয় জোট। ২০১৫ সালের প্রথম দিনটি ছিল জামায়াতের হরতাল। ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ পালন করছে বিএনপি। প্রথম দিন ঢাকায় যানবাহন চললেও মহাসড়ক ছিল ফাঁকা। তার পরও মঙ্গলবার রাত থেকে কিছু কিছু যানবাহন চলতে শুরু করে। গতকাল সারা দেশেই যানবাহন চলেছে, এমনকি মহাসড়কেও। এরই মধ্যে দুপুরে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ অবরোধ কর্মসূচি চলমান থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।  ঢাকার প্রগতি সরণির ফুটপাতের চায়ের দোকান মালিক বাদশা মিয়া ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে দেননি। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হওয়ায় ওই নির্বাচন নিয়ে তাঁর মনেও প্রশ্ন আছে। তার পরও গত সোমবার ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ আর ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবসের ডামাডোলে নিজের চায়ের দোকান না খুলতে পারায় শ পাঁচেক টাকা লোকসান কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। গণতন্ত্র বা ভোটাধিকারের জন্য নিজের দোকান পুড়ে যাক তাও তিনি চান না। ‘দোকান হারাইয়া আমার ভোটের দরকার নাই’- বাদশা মিয়ার সাফ কথা। এমনিতেই লোকসানে নাকাল তিনি, অবরোধ কত দিন চলে তাও অজানা। গত দুই দিনের অবরোধে ক্রেতা না পাওয়ায় বাদশা মিয়া হতাশ। মঙ্গলবার তাঁর দোকানে বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকা, গতকাল হয়েছে এক হাজার টাকার বেশি। স্বাভাবিক দিনে তিনি দেড় হাজার টাকার বেশি বিক্রি করেন। বাংলাদেশে মোট পরিবারের সংখ্যা দুই কোটি ৮৬ লাখ ৯৬ হাজার। এর মধ্যে এক কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার কৃষক পরিবার। তারা সবাই আওয়ামী লীগ ও জোটমিত্রদের সমর্থক নয়, অনেকেই বিএনপি ও এই জোটের সমর্থক। কিন্তু হরতাল-অবরোধে তারা ফসল বিক্রি করতে পারছে না। উত্তরের জেলাগুলোতে ফুলকপির দাম নেমেছে কেজিপ্রতি এক টাকায়। দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের প্রায় চার হাজার কারখানা সচল আছে। এসব কারখানার মালিকদের রাজনৈতিক মতাদর্শে ভিন্নতা আছে, তবে সংগঠনটি সব সময় হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির ঘোর বিরোধী। বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীরাও অবরোধের মধ্যে পণ্য রপ্তানি অব্যাহত রাখতে পুলিশি নিরাপত্তায় ট্রাকের বহর পাঠাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ২০১৩ সালে সারা দেশে সাদা পতাকা কর্মসূচি পালন করে জানিয়েছে, ব্যবসায়ীরা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কর্মসূচির বিপক্ষে। গতকাল যেকোনো স্বাভাবিক দিনের মতোই যানজট ছিল ঢাকায়। মহাসড়কে পণ্যবাহী যান চলেছে, যাত্রীবাহী পরিবহনও চলতে শুরু করেছে। ট্রেন চলেছে, লঞ্চ চলেছে, অবরোধ আছে নামকাওয়াস্তে। এ অবস্থায় বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে টিটকারি করছেন অনেকে। বিএনপির সক্ষমতাকে টিটকারি করতে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ঘোষণা দিয়ে লুঙ্গি পরে রাস্তায় নেমেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, বিএনপি পারে না, পালিয়ে গেছে- এ ধরনের বক্তব্যের সত্যতা বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। তবে দল হিসেবে এ ধরনের কর্মসূচি দিয়ে ‘পলিটিক্যাল ডিভিডেন্ড’ বা রাজনৈতিক অর্জন কী, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকারি দলের বিরুদ্ধে জনগণকে জড়ো করার অনেক অস্ত্র আছে। যেমন দুর্নীতি, দখল ইত্যাদি। কিন্তু হিংস্র উপায়গুলো এখন আর কাজ করছে না।’ ২০১৩ সালের নজিরবিহীন সহিংসতার পর ২০১৪ সালে যে হরতালগুলো হয়েছে, তাতে তেমন কোনো সহিংসতা হয়নি। ধারণা করা হয়েছিল, বিএনপি নতুন ধরনের রাজনীতি শুরু করবে। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির হরতালের আগের দিন রাতে কাজীপাড়ায় পেট্রলবোমা হামলায় একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হয়। পরের দিন ইটের আঘাতে নিহত হন একজন শিক্ষিকা। এর দায় বিএনপির ওপর চাপিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে সরকারের স্যাবোটাজ বলে দাবি করেছেন। গণমাধ্যমে হরতাল-অবরোধে সহিংসতার চিত্র দেখে দেশের মানুষের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়ে- এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রভাবটা মিশ্র, কারণ এ দেশের মানুষ দলীয়ভাবে বিভক্ত। সরকার সমর্থকরা মনে করে, সহিংসতার কারণ বিরোধীরা। বিরোধী দল সমর্থকরা মনে করে, এর কারণ সরকার। আর নিরপেক্ষরা মনে করে, দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণে এটা হচ্ছে। তবে সব মানুষের মধ্যেই আতঙ্ক তৈরি হয়।’ আতঙ্ক তৈরি করে হরতাল-অবরোধ পালনে বাধ্য করার চেষ্টা আর কাজ করছে না উল্লেখ করে শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘জনগণ এখন অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে বেশি চিন্তিত। মানুষের আয় বেড়েছে, তারা আরো উন্নত জীবন চায়। তারা চায় স্থীতিশীলতা।’ তিনি মনে করেন, সন্ত্রাসনির্ভর কর্মসূচি না দিয়ে বিএনপি সরকারের ভুলগুলো তুলে ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। অবরোধ ডেকে মাঠে নেই বিএনপি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিলেন, অথচ মাঠে নামছে না তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা। রাজপথে নেই দলের বড় নেতাদের কেউই। গত দুই দিনে দেশের কোথাও তেমন কোনো শোডাউন দেখাতে পারেনি দলটি, বরং তাদের জোটসঙ্গী জামায়াত-শিবির দু-একটি জায়গায় মাঠে নেমেছে। এর আগে হরতালেও ছিল প্রায় একই অবস্থা। কিন্তু কেন? বিভাগীয় শহরগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব, দলের মধ্যে অনৈক্য, সরকারের সঙ্গে বড় নেতাদের অনেকের গোপন আঁতাত, পুলিশের মারমুখী আচরণ, মামলা-হামলা, বিশেষ করে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের ভয়ের কারণে কোনো আন্দোলনই  জমাতে পারছে না দলটি। নেতারা মাঠে না নামায় কর্মীরাও মাঠে নামার সাহস বা আগ্রহ বোধ করছে না। সিলেট : কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় ইস্যুতে নিজেদের ডাকা কর্মসূচিতেই বিএনপি নেতাদের মাঠে দেখা যায় না নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব, দলের মধ্যে অনৈক্য, মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে। নেতাদের কোন্দলের কারণে কর্মীরাও বিভক্ত। ফলে তাদের একসঙ্গে রাজপথে দেখা যায় না। বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা ভয়ে মাঠে নামতে পারছেন না। রাস্তায় নামলে পুলিশ গুলি ছোড়ে, লাঠিপেটা করে, গ্রেপ্তার করে। আবার অনেক নেতার দাবি, মাঠপর্যায়ে ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও দলে যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাবাদীরা কমিটিতে স্থান পায়। এই মনোকষ্ট থেকে অনেকেই মাঠে নামার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এ বিষয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আলী আহমদ বলেন, ‘এরশাদের আমলেও পুলিশ এত মারমুখী ছিল না। গত ছয় বছরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর জেলায় আড়াই শ থেকে তিন শ মামলা হয়েছে। ফলে ভয়ে নেতা-কর্মীরা মাঠে নামছে না।’ মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকি বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে আন্দোলন করবে কর্মীরা। নেতারা রাস্তায় থাকবে কেন? নেতারা রাস্তায় থাকলে আন্দোলনের পরিকল্পনা করবে কে? নেতারা বড় মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন। অবরোধে মাঠে থাকবে কর্মীবাহিনী। নেতারা প্রয়োজন মনে করলে মাঠপর্যায়ে যাবেন।’ তিনি আরো বলেন, বর্তমান কমিটি নিয়ে বিরোধ থাকায় অনেকে মাঠে নেই। বিরোধ মিটে গেলে অনেকে নামবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, সিলেটের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই সমঝোতার মধ্য দিয়ে চলছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও আওয়ামী লীগ কর্মসূচি পালন করেছে সমঝোতার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ অতীতে ক্ষমতায় থাকাকালেও একইভাবে বিএনপি কর্মসূচি পালন করেছে। এবারই এই ট্রাডিশন একেবারে ভেঙে গেছে। পুলিশ মারমুখী অবস্থান নেওয়ায় নেতারা ঘর থেকে বের হতে ভয় পান। চট্টগ্রাম : মূলত পুলিশের ভয়ে রাজপথে নামছেন না বিএনপির নেতা-কর্মীরা। গত ৫ জানুয়ারি কাজীর দেউড়ি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা-গ্রেপ্তারের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী আত্মগোপনে চলে গেছে। তবে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের দাবি, মামলা-হামলা এড়িয়ে চলার জন্য সিনিয়র নেতারা একসঙ্গে হচ্ছেন না। সবাই পৃথকভাবে যাঁর যাঁর এলাকায় অবরোধ পালন করছেন। মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আবু সুফিয়ান বলেন, ‘গত ৫ জানুয়ারি একসঙ্গে ৩০০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার ও ৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। এখন গ্রেপ্তার আতঙ্কে আমাদের নেতা-কর্মীরা ঘরছাড়া। তবে কয়েক দিন পর তাঁরা মাঠে নামবেন বলে আশা করেন তিনি। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন কি না- প্রশ্নের জবাবে নগর শ্রমিক দলের সভাপতি এম নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে কর্মসূচি নিয়ে আমাদের গত দুই দিন কোনো সমন্বয় হয়নি।’ নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) মো. মিজানুর রহমান বলেন, রাজপথে কোনো মিছিল-সমাবেশ নেই। সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। রাজশাহী : ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন ১৮ দলের ডাকা অবরোধ চলাকালে রাজশাহী কলেজের সামনে বড় ধরনের শোডাউন ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এর আগে-পরে এমনকি চলতি সরকারের আমলে ডাকা অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচিতেও নগরীতে মাঠে তেমন দেখা যায়নি দলটির নেতা-কর্মীদের। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, মামলা ও পুলিশি হামলার ভয়ে এখানকার নেতারা মাঠে নামতে চান না। কর্মীরা নামতে চাইলেও সঙ্গে নেতাদের পায় না। এ জন্যই মূলত কেন্দ্রীয় বা স্থানীয়ভাবে ডাকা কর্মসূচিগুলোতে বিএনপি নেতা-কর্মীরা থাকেন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। কিন্তু নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে বরাবরই মাঠে নামছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা।  নগর বিএনপির একাধিক নেতা-কর্মী বলেছে, ‘হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে বিএনপি নেতা মিনুর নেতৃত্বে সকালের দিকে বড়জোর একটি বিক্ষোভ মিছিল হয়। এরপর তিনিসহ অন্য নেতারা ঘরে অথবা দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে যান। তখন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আর ঝুঁকি নিতে চায় না।’ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, ‘রাজশাহীতে আন্দোলন হয় না, এটা ঠিক নয়। আমরা প্রতিটি আন্দোলনেই মাঠে থাকি। তবে কখনো কখনো মাঠে না থাকলেও আমাদের নামে পুলিশ অযথা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। তবে এর পরও আন্দোলন থেমে নেই।’ তবে প্রায় প্রতিটি কর্মসূচিতে জামায়াত-শিবির মাঠে নামছে। বিএনপির কর্মসূচিতেও তারা মাঠে থেকে নিজেদের শক্তি জানান দিচ্ছে। মঙ্গলবার তারা নগরীর আলিফ লাম মীম ভাটা এলাকায় অস্ত্র কেড়ে নিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। বরিশাল : পুলিশের ভয়ে অবরোধে মাঠে নামেনি বিএনপি নেতা-কর্মীরা। ৫ জানুয়ারি দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবর রহমান সরোয়ার একটি দায়সারা মিছিল করলেও গত দুই দিনে তাঁকে মাঠে পাওয়া যায়নি। জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়দুল হক চান ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শাহীনের কোনো খোঁজই নেই। তবে হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠেছে শিবির। তারা গতকাল সকালে নগরের সিঅ্যান্ডবি রোডে মিছিল শেষে দুটি অটোরিকশায় আগুন দেয় এবং দুপুরে বাঘিয়া মাদ্রাসা এলাকায় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ করে।  এ বিষয়ে জানতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও মহানগর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়দুল হক চান বলেন, ‘আমরা যেখানে যাই সেখানেই পুলিশের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তাই কর্মসূচি পালন করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে শিবির ২০ দলীয় জোটেরই একটা অংশ, তাই তারা কর্মসূচি পালন করবে, এটাই স্বাভাবিক।’ খুলনা : জেলায় আন্দোলনে প্রাণ ফেরাতে পারছে না বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। সারা দেশে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটলেও খুলনায় এর প্রভাব পড়ছে না। জামায়াত-শিবিরের তৎপরতাও সীমিত। বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সরকারি দল ও প্রশাসনের আঁতাতের কারণে এ অবস্থা। নেতারা আন্দোলনের কঠোর অবস্থানে যেতে চান না। আর এ কারণেই অতীতে পুলিশের দায়ের করা কোনো মামলায়ই আসামি হননি ওই নেতারা। তবে শীর্ষস্থানীয় নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আন্দোলন চাঙ্গা করতে তাঁদের কোনো দুর্বলতা নেই। বরং তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে পড়ে, শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন, হয়রানি, জুলুমে নাজেহাল হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জেলা বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, বড় নেতারা ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তাঁরা দলের পদ রাখতে কর্মসূচিতে হুংকার দেন আর গোপনে ঝুঁকি নিতে নিষেধ করেন। তাই খুলনায় হরতাল ও অবরোধ কিছুই হয় না। এ অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপির বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘সমঝোতার প্রশ্নই আসে না। আন্দোলন চাঙ্গা করতে আমাদের কোনো কার্পণ্য নেই। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নির্যাতন-নিপীড়নে কর্মীরা আতঙ্কিত। একেকজনের নামে পাঁচ-সাতটি করে মামলা থাকায় কর্মসূচি পালনে তার কিছুটা প্রভাব পড়ছে। অচিরেই এ অবস্থা পাল্টে যাবে।’ জামায়াতের মহানগর আমির মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘খুলনায় আন্দোলন হচ্ছে না সে অভিযোগ সঠিক নয়; আমরা জোটের সঙ্গে মিছিল-মিটিং ও আন্দোলনের ময়দানে রয়েছি।’

No comments:

Post a Comment