Wednesday, January 14, 2015

দূরের জেলাগুলোয় কৃষকের মরণ:কালের কন্ঠ

ঢাকার বাজারে টমেটোর দাম বেশি নয়, কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা। ১০০ টাকার একটি নোট দিলে ভালো মানের কেজি তিনেক টমেটো মেলে যেকোনো বাজারে। কিন্তু রাজশাহীতে টমেটোর দাম কেজিপ্রতি আ
ড়াই টাকায় নেমেছে। অবরোধ শুরুর আগে যে কৃষক ৩৬০ টাকা মণ বা ৯ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করেছেন, এখন সেই কৃষক দাম পাচ্ছেন মণপ্রতি মাত্র ১০০ টাকা, যা কেজিতে দাঁড়ায় আড়াই টাকা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে ঢাকায় সবজির সরবরাহ কমে গেছে। ওই সব জেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন শত শত ট্রাকে করে সেখান থেকে রাজধানীতে সবজি আসে। শিথিল অবরোধের মধ্যে আশপাশের জেলা থেকে সবজিবাহী ট্রাক আসতে তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু দূরবর্তী জেলা থেকে ফড়িয়ারা সবজি নিয়ে আসার ঝুঁকিও নিচ্ছে না। আবার পুড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কায় ট্রাক মালিকরাও ট্রাক ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছে না। যারা রাজি হচ্ছে তারা ভাড়া চাইছে দ্বিগুণ। অবশ্য ঢাকার বাজারে সবজির দাম বাড়েনি। কিছুদিন আগেও যে টমেটো ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, তা এখন ৩০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চাহিদা কম। উৎসব-অনুষ্ঠান কমে গেছে। পাশাপাশি মানুষজন বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতেও শঙ্কিত। ফলে দূর থেকে বেশি খরচ করে নিয়ে আসা সবজির ভালো দামও মিলছে না। শেষ পর্যন্ত সব মাসুল কৃষককেই দিতে হচ্ছে। পাইকারি বাজারে ফড়িয়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম থাকায় প্রতিযোগিতা কম হচ্ছে। কৃষকের সবজির দাম আরো কমে যাচ্ছে। বগুড়ার নয়মাইল বাজারে গতকাল মঙ্গলবার প্রতি কেজি শিম পাঁচ টাকা, বেগুন আট, মুলা তিন, বাঁধাকপি পাঁচ থেকে ছয়, ফুলকপি প্রতি মণ ৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে প্রতি মণ বেগুন বিক্রি হয়েছে সাড়ে তিন থেকে চার টাকা দরে। এ ছাড়া প্রতি ফুলকপি এক থেকে দেড় টাকা, প্রতি কেজি শিম ৮-৯ টাকা, মুলা ৫০ পয়সা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর সেকশন ও কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি শিম ২৫ থেকে ৪০ টাকা, বেগুন ৩০-৪০ টাকা, মুলা ১৫-২০ টাকা, বাঁধাকপি প্রতিটি ২০-২৫ টাকা ও ফুলকপি প্রতিটি ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। কারওয়ান বাজারের আড়ত মালিক মোশারফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন যেসব সবজি আসছে তার বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গ থেকে আসা। তবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন সরবরাহ কম। তিনি জানান, যে ট্রাকের ভাড়া ২০ হাজার টাকা ছিল, এখন তা ৪০ হাজার। গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় অবরোধ। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর টমেটোচাষিদের দুর্দিন। উপজেলার পিরিজপুর গ্রামের টমেটোচাষি গোলাম রসুল জানান, তিনি এ বছর প্রায় ছয় বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছেন। অবরোধ শুরু হওয়ার আগেও তিনি প্রতি মণ টমেটো বিক্রি করেন ৩৬০ টাকা দরে। কিন্তু সেই টমেটো গতকাল বিক্রি করেন প্রতি মণ ১০০ টাকা দরে। টমেটো জমি থেকে তুলে বাজারজাত পর্যন্ত যে খরচ, সেটিও উঠছে না বলে দাবি করেছেন গোলাম রসুল। গোদাগাড়ীতে টমেটো কিনতে আসা চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ী শাহজাহান আলী জানান, অবরোধের আগে গোদাগাড়ী থেকে চট্টগ্রামে টমেটো পরিবহনের জন্য প্রতি ট্রাকের ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর দু-একটি করে ট্রাক ঝুঁকি নিয়ে চললেও তার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৬০-৬৫ হাজার টাকা করে। আবার কখনো কখনো ট্রাকে আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে রাতারাতি দ্বিগুণের বেশি ট্রাক ভাড়া দিতে গিয়েই হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। গত এক সপ্তাহে রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০টি পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন দিয়েছে অবরোধ সমর্থকরা। সর্বশেষ গত সোমবার দুপুরে নগরীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর এলাকায় একটি সবজি বহনকারী ট্রাকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে প্রতি মণ বেগুন বিক্রি হয়েছে ১৫০-১৮০ টাকা দরে। এ ছাড়া প্রতি মণ ফুলকপি ৪০-৫০ টাকা, শিম ৩৫০-৩৮০ টাকা, মুলা ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। শুধু বানেশ্বর বাজারেই নয়, রাজশাহীর প্রতিটি বাজারেই এ রকম দরে পাইকারি সবজি বিক্রি হচ্ছে। রাজশাহীর পবার পারিলা এলাকার বেগুনচাষি হযরত আলি জানান, তিনি এবার প্রায় চার বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করেন। এমনিতেই এবার শীতের শুরু থেকেই বেগুনসহ বিভিন্ন সবজির দাম কম। এর ওপর গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া অবরোধের মধ্যে পড়ে সবজির দাম আরো কমে গেছে। বগুড়ার নয়মাইল বাজারে প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে পাঁচ টাকায়। প্রতি কেজি বেগুন ও মুলা পাওয়া যাচ্ছে তিন থেকে আট টাকার মধ্যে। আর বাঁধাকপি প্রতিটি পাঁচ থেকে ছয় টাকা দাম ধরা হলেও কোনো ক্রেতা নেই। সবজির অন্য একটি বৃহৎ হাট মহাস্থানগড়ে প্রতি মণ ফুলকপি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫০ টাকায়। সবজির বাজারে এই অরাজক পরিস্থিতি চলছে এক সপ্তাহ ধরেই। টানা অবরোধ ও আঞ্চলিক হরতালের প্রভাবে বাজারে এই অস্থিতিশীল অবস্থা। হাটে স্তূপ করে রাখা সবজি পচে নষ্ট হচ্ছে। আবার কোনো কোনো স্থানে পরিবহনের অভাবে কৃষক জমি থেকে ফসল তুলছে না। বগুড়ার নয়মাইল বাজারে সোমবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বসে থেকেও এক ভ্যান ফুলকপি বিক্রি করতে পারেননি কৃষক আবুল প্রামাণিক। তিনি বলেন, একে তো অবরোধ তার ওপর আবার হরতাল দিচ্ছে। পাইকার আসবে কেমন করে? মহাস্থান হাটে আলুচাষি মো. ইব্রাহীম জানান, দুই দিন আগে ওই হাটে ৫০০ টাকা মণ দরে আলু বিক্রি করেছেন। বাজারে গতকাল সেই আলু বিক্রি হয়েছে ৩৪০ টাকা দরে। তিনি বলেন, 'বাজারে ১০ গাড়ি সবজি কেনার মতো পাইকার আছে। কিন্তু অবরোধের কারণে পণ্য নিয়ে যেতে পারছে না বলে কিনছে না।' হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার দ্বিগাম্বর বাজারের আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় দুই হাজার কৃষক শিমসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ করেছে। তারা সপ্তাহের শনি, সোম ও বৃহস্পতিবার বাজার বারের দিন দ্বিগাম্বর বাজারে সবজি নিয়ে আসে বিক্রি করতে। সেখানে বিভিন্ন জেলার প্রায় ১০০ পাইকার রয়েছে। তারা সবজি ক্রয় করে ট্রাক বোঝাই করে এই সবজি নিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকায়। প্রতি বাজার দিনে এখান থেকে গড়ে ৪০টি ট্রাক ছাড়ে। কিন্তু অবরোধের জন্য এখন ছাড়ে মাত্র তিন থেকে চারটি ট্রাক। তাও চলাচল করে জেলার ভেতরে। প্রতিবেদনটি লিখতে সহায়তা করেছেন কালের কণ্ঠের রাজশাহী কার্যালয়ের নিজস্ব প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম, বগুড়ার নিজস্ব প্রতিবেদক লিমন বাসার ও হবিগঞ্জ প্রতিনিধি শাহ ফখরুজ্জামান।    

No comments:

Post a Comment