Friday, January 30, 2015

কঠিন বার্তা নিয়ে ঢাকা ছাড়লেন পুলিশ সুপাররা:প্রথম অালো

দেশব্যাপী ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগসহ চলমান সহিংস পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মতো পুলিশ প্রশাসনও উদ্বিগ্ন। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শকও (আইজিপি) ‘যা যা করণীয়’ তাই করার কথা বললেন। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে সারা দেশ থেকে আসা পদস্থ কর্মকর্তারা গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর রাতেই অপরাধবিষয়ক বার্ষিক স
ম্মেলনে মিলিত হন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ কঠোর ও কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। সম্মেলনে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তিন দিনের পুলিশ সপ্তাহের কর্মসূচি গতকাল শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কর্মসূচি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব জেলার পুলিশ সুপারকে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরত যেতে বলা হয়। তিন দিনের বৈঠকের পর কঠিন বার্তা নিয়ে কাল দুপুরেই তাঁরা ঢাকা ছেড়েছেন। উচ্চপর্যায় থেকে পুলিশ সুপারদের নিজ নিজ এলাকায় বিশেষ অভিযান আরও জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, হামলাকারীদের ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় দেওয়া যাবে না। সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। সম্মেলনে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বাহিনীর শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে প্রতি সপ্তাহে সবকিছু খতিয়ে দেখতে (মাস্টার প্যারেড) কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সবাইকে পেশাদারির সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে। প্রতিবছরই পুলিশ সপ্তাহের সময় আগের বছরের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এই আলোচনায় গেল বছরের পরিস্থিতি যেমন তুলে ধরা হয়, তেমনি আগামী বছরের অপরাধ দমন কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়। অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পক্ষ থেকেও অপরাধ পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সারা দেশের পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত সব পদের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হওয়া সম্মেলন শেষ হয় রাত পৌনে ১২টায়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সম্মেলনের শুরুতেই পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিস্থিতি যেমনই হোক, এবারের এসএসসি পরীক্ষা সময়মতোই হবে। এ জন্য পরীক্ষার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বৈঠকে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মল্লিক ফকরুল ইসলাম বলেন, দুর্বৃত্তরা রাতের বেলা মহাসড়কের ওপর আলকাতরা ছড়িয়ে রাখছে। এতে গাড়ির চাকা পিছলে দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার তারা রাস্তার ওপর ত্রিশঙ্কু ফেলে রাখছে, এতে গাড়ির চাকা ফুটো হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থামামাত্র পেট্রলবোমা মারছে। পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী বৈঠকে বলেন, এখন দরকার গোয়েন্দা-তথ্যনির্ভর পুলিশিং। আগে থেকে সব তথ্য নিয়ে পুলিশকে দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে পুলিশ পাহারায় যানবাহন ঢাকায় আসছে। দেখা যাচ্ছে একসঙ্গে ৪০-৫০টি গাড়ি আসছে। বহর লম্বা হওয়ায় অনেক সময় সব গাড়ি নজরে রাখা যাচ্ছে না, হামলার শিকার হচ্ছে। এ জন্য গাড়ির বহরকে ছোট করতে হবে, যাতে সব যানকে নিরাপত্তা দেওয়া যায়। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার বৈঠকে বলেন, গাড়িতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রাখতে বলা হলেও কেউ তা মানছে না। এতে করে গাড়িতে আগুন দেওয়া হলে নেভানো যাচ্ছে না। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি দিলে সবাই আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রাখবে। বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বৈঠকে বলেন, উত্তরাঞ্চল থেকে যেসব সবজির ট্রাক ঢাকায় আসছে, সেগুলোকে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু ট্রাকগুলো এলোমেলো চলার কারণে অনেক সময় হামলার মুখে পড়ছে। সবজিভর্তি ট্রাক একসঙ্গে আনা হলে নিরাপত্তা দেওয়া সহজ হবে। লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বৈঠকে বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের অনেক কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, ১০ বছরের মধ্যে তারা বড় ধরনের আন্দোলনে নামবে। এ জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা অমুসলিমদেরও সহায়তা নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুরে জামায়াতের ১২ জন অমুসলিম সমর্থক আছে। এসব ব্যাপারে এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, অপরাধে জড়িত শিবির কর্মীদের ছবিসহ তালিকা করা যেতে পারে। এ তালিকা জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দিলে এঁদের গ্রেপ্তার করা সহজ হবে। ভোলা জেলার পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা পুলিশকে সহায়তা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অনেক সহজ হবে। ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, হরতাল অবরোধের সময় যারা সাহস করে গাড়ি নামাচ্ছে, পুলিশ তাদের গাড়িই রিক্যুইজিশন করছে। এটা বন্ধ না করলে ভয়ে কেউ গাড়ি রাস্তায় নামাবে না। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল বলেন, ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনের সময় ঢাকায় যাদের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, তারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামের লোকজন ক্ষতিপূরণ পায়নি। রেলওয়ের ডিআইজি রুহুল আমিন বলেন, অবরোধের সময় ট্রেন চালানো হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীরা ট্রেনের জানালা-দরজা খোলা রাখছে। এতে যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। ট্রেন চলার সময় এর জানালা-দরজা বন্ধ রাখতে হবে। আবার ট্রেনের সব বগিতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রাখা হলে অনেক পরিস্থিতি এড়ানো যাবে। রেলের নিরাপত্তায় বেশি করে আনসার দিতে সুপারিশ করেন তিনি। পুলিশের বিশেষ শাখার এসএস আজাদ মিয়া বৈঠকে বলেন, অবরোধ-হরতালের সময় একটি হটলাইন চালু করা যেতে পারে। যাতে করে কোথাও কোনো নাশকতা ঘটলে মানুষ দ্রুত খবর দিতে পারে। গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রটোকল দিতে গিয়ে জেলার অন্য কাজ করা যাচ্ছে না। তিনি শুধু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রটোকলের জন্য নতুন শাখা গঠনের পরামর্শ দেন। সবার বক্তব্যের পর পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, সবকিছু শিখিয়ে দেওয়া যাবে না। নিজের বিবেকে বুঝে-শুনে, অঙ্গীকার থেকে কাজ করতে হবে। কাজের সময় কারও সঙ্গে যাতে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সব গোয়েন্দা সংস্থা বা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। বৈঠকের ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে অনেক কথাই আসতে পারে। তবে চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল সবার বক্তব্যের মূল সুর। বৈঠক থেকে সবাইকে আইন মেনেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের রাখতে বলা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment