Sunday, January 18, 2015

রোগী আসতে পারছে না ফোনে ফোনে চিকিৎসা:কালের কন্ঠ

ছয় মাস আগে মাথা ও কোমরে ব্যথা নিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে শামসুল আলম নামের এক যুবক চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেন। সুস্থ হয়
ে বাড়ি চলে যাওয়ার পর সম্প্রতি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। লাগাতার অবরোধে দূরপাল্লার গাড়ি না চলায় হাসপাতালে আসতে পারছেন না দিনমজুর শামসুল আলম। স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় চট্টগ্রামে চিকিৎসকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে নিজের অসুখের কথা বলেন শামসুল। নিরুপায় হয়ে চিকিৎসক রোগী না দেখে তাঁর সমস্যার কথা শুনে ফোনেই চিকিৎসা দিচ্ছেন। মোবাইল ফোনে শামসুলকে চিকিৎসা দেওয়ার কথা জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তিনি আমার ওয়ার্ডে ছয় মাস আগে ভর্তি ছিলেন। তখন আমি তাঁকে দেখেছিলাম। আবার তাঁর মাথা ও কোমর ব্যথা বেড়ে গেলেও অবরোধের কারণে হাসপাতালে আসতে পারছেন না। এসব কথা শুনে মোবাইল ফোনে বাধ্য হয়ে ওষুধ দিতে হচ্ছে।' এ চিকিৎসক আরো বলেন, 'শুধু আমি না, অবরোধের কারণে যাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের চেম্বারে আসতে পারছেন না তাঁদেরও অনেক চিকিৎসক এভাবে ফোনে চিকিৎসা দিচ্ছেন।' কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ এবং দফায় দফায় হরতালের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ১০১০ শয্যার সরকারি এ হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন দুই হাজার ২০০ থেকে ৩০০ রোগী ভর্তি থাকে। গত ৫ জানুয়ারি পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরুর আগের দিন দুই হাজার ৩৬৮ জন রোগী ৩৬টি ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল। এর আগে ১ থেকে ৩ জানুয়ারি যথাক্রমে ২০৫৯, ২১৮৯, ২২৮৬ এবং ৫ জানুয়ারি ২২৯১ জন ভর্তি ছিল। অবরোধ শুরুর পর প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই শ রোগী কমেছে। সর্বশেষ গত ১৫ জানুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতালের দিন রোগী ভর্তি ছিল ১৯৯৫ জন। এ ছাড়া ৬ থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত যথাক্রমে ২২১১, ২১৫৮, ২০৭২, ২১৯০, ২১৩৫, ২১১০, ২১১৫, ২০৯০, ২০৫৩ ভর্তি ছিল। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দুই হাজার ৮২ জন রোগী হাসপাতালের ৩৬টি ওয়ার্ডে (ইনডোর) চিকিৎসাধীন ছিল। এর মধ্যে ওই ২৪ ঘণ্টায় ইনডোর (অন্তর্বিভাগ) ও আউটডোরে (বহির্বিভাগ) ভর্তি হয়েছে ৩৩৯ জন রোগী। অথচ গত ১ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৪১৩ জন রোগী ভর্তি হয়। জানা যায়, হাসপাতালের ইনডোরে অবরোধের পর থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই শর বেশি রোগী কম ভর্তি হচ্ছে। এ ছাড়া আউটডোরেও গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ রোগী কমেছে। ৫ জানুয়ারি আউটডোরের ১৮১৩ জন রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। পরদিন চট্টগ্রামে ২০ দলীয় জোটের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। হরতাল ও অবরোধের মধ্যে এদিন ১১৪০ জন রোগী আউটডোরে আসে। একইভাবে ১৫ জানুয়ারি দিনব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের দিন ১০৩৭ জন রোগী আসে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও রোগী কমেছে ৫ জানুয়ারির পর থেকে। ১ থেকে ৫ জানুয়ারি যথাক্রমে ৪২০, ৫১০, ৬৪০, ৫৯০, ৫৩০ জন রোগী জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয়। চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিন গড়ে ৫৩৮ জন করে চিকিৎসা নিয়েছিল জরুরি বিভাগে। এর মধ্যে অনেকে ভর্তি হয়েছে। ৬ থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত যথাক্রমে ৪৬০, ৪৭০, ৪৬০, ৪৮০, ৪৭২, ৫১৮, ৫১০, ৫২০, ৫১০, ৪৬০, ৪৫০ চিকিৎসা নেয় ওই ওয়ার্ডে। গত ১১ দিন প্রতিদিন গড়ে ৪৮২ জন করে চিকিৎসা নিতে আউটডোরে আসে বলে চিকিৎসকরা জানান। অবরোধ-হরতালের কারণে হাসপাতালে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও আগের থেকে কমেছে। বিষয়টি স্বীকার করে হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ডা. বিধান সেনগুপ্ত বলেন, ৬ জানুয়ারির আগে প্রতিদিন গড়ে ইনডোরে ১০০ জনের বেশি এবং আউটডোরে ৮০ জনের বেশি রোগী বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আসত। অবরোধের কারণে এখন ৬০-৭০ জন ইনডোর এবং ৫০-৬০ জন আউটডোর রোগী ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিতে আসছে। উভয় বিভাগে ৩০-৪০ জন করে রোগী কমেছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. খোন্দকার শহিদুল গণি কালের কণ্ঠকে বলেন, অবরোধের কারণে হাসপাতালে ১০০ থেকে ১৫০ জনের মতো রোগী ভর্তি কমেছে। জরুরি রোগী হাসপাতালে আসছে। মনে হচ্ছে, যেসব রোগী দূর-দুরান্ত থেকে এখানে আসতে পারছে না তারা আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। এ হাসপাতালে ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ, তিন পার্বত্য জেলাসহ বিভিন্ন এলাকার রোগী আসে চিকিৎসা নিতে। রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানা অবরোধের কারণে গণপরিবহন কম চলাচল করায় রোগীদের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। জরুরি চিকিৎসাসেবা নিতে হালকা বিভিন্ন যানবাহনে করে যেসব রোগী হাসপাতালে আসছে তারা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার প্রেমবাজার এলাকা থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে হৃদরোগে আক্রান্ত জোবাইদা খাতুনকে (৫০) মঙ্গলবার দুপুর ২টায় হাসপাতালে আনা হয়। গতকাল দুপুর ১টায় তাঁকে ওয়ার্ড থেকে ছাড়পত্র দিলে অসুস্থ মাকে নিয়ে তাঁর ছেলে মোক্তার আহম্মদসহ পরিবারের লোকজন হাসপাতালে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। তিন ঘণ্টা ৪০ মিনিট অপেক্ষার পর একটি অটোরিকশা নিয়ে বাঁশখালীর উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। মোক্তার আহম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মঙ্গলবার বাড়ি থেকে আসার সময় ভাগ্য ভালো যে বাঁশখালী মেডিক্যালের অ্যাম্বুল্যান্স পেয়েছিলাম। আজ (শনিবার) বাড়ি যেতে কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। শেষ পর্যন্ত ৬০০ টাকা দিয়ে একটি অটোরিকশা ভাড়া করতে বাধ্য হয়েছি।' খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই নয়, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার অন্য সরকারি ও বেসরকারি অর্ধশতাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অবরোধের কারণে রোগী আসতে পারছে না। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগী কমেছে।    

No comments:

Post a Comment