
পর্যটক নেই বললেই চলে। রেস্তোরাঁগুলোতেও ব্যবসা হচ্ছে না। এসব কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছেন পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা। ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু হোটেল-রিসোর্টের ক্ষতিই ৫০ কোটি টাকা। এ তথ্য টুরিজম ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের। সংগঠনের সভাপতি জামিউল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়েই আবাসন (হোটেল-রিসোর্ট), পরিবহন, খাদ্য ও পানীয় (রেস্টুরেন্ট) এবং বিনোদন (বিনোদন পার্ক)—এই চারটি খাতকে একত্রে পর্যটন খাত গণ্য করা হয়। এই চারটি খাতের ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক তথ্য বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন খাতের এই ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। জামিউল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের পর্যটন খাতে এখনো দেশি পর্যটকই বেশি। এখন পর্যটক একদমই কমে গেছে। টাকা দিয়ে তো আর কেউ মৃত্যু কেনে না। এটা আমাদের সর্বোচ্চ সময় (পিক সিজন)। কিন্তু যত গন্ডগোল এই সময়টাতেই হচ্ছে।’ শুধু তা-ই নয়, বিদেশি পর্যটকেরা এ দেশে তাঁদের ভ্রমণ বাতিল করছেন। বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ নিয়ে কাজ করা সংগঠন টুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাবে, এ বছরের রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশ অগ্রিম বুকিং বাতিল হয়েছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত এটা ৭৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। টোয়াবের পরিচালক তৌফিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী, শুধু বেড়ানোর জন্য জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাত হাজারের মতো বিদেশি পর্যটকের এ দেশে আসার কথা। এর বড় অংশ বুকিংও দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তাঁরা এখন তাঁদের বুকিং বাতিল করছেন। এসব পর্যটক আমরা আর পাব না। সে হিসাবে, মার্চ পর্যন্ত আমাদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা।’ বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে এখন কোনো পর্যটক নেই। সে কারণে শহরের তিন শতাধিক হোটেল-মোটেল-গেস্টহাউস-কটেজ খালি পড়ে আছে। এর সঙ্গে আছে সাত শতাধিক রেস্তোরাঁসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় পর্যটক না থাকায় কক্সবাজারের পর্যটন খাতে প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১৪ কোটি টাকা। কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ১৭ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত সাত লাখ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণ করেন। এখন পুরো শহরে ১০০ জন পর্যটকও নেই। প্রতিটি হোটেল দৈনিক ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান দিচ্ছে। ইতিমধ্যে আনুমানিক ১২ হাজার কর্মচারীও ছাঁটাই হয়েছে। কক্সবাজারে বেড়াতে এসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যান না এমন পর্যটক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর সেন্ট মার্টিন যেতে পাড়ি দিতে হয় জাহাজে। কিন্তু অবরোধের পর থেকে পর্যটক না থাকায় এসব জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। টেকনাফে পর্যটক পরিবহনকারী জাহাজ এলসিটি কাজলের ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান জানান, পর্যটক পরিবহন করে গত বছর এ সময় জাহাজগুলো প্রায় ২০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। এবার লাভ তো হয়নি, বরং ২০ দিনে ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। জানা গেছে, সেন্ট মার্টিনে ৩৮টি আবাসিক হোটেল, ৮১টি কটেজ-বাংলো আছে। প্রায় সবগুলোই খালি। ১০৫টি ছোট-বড় রেস্তোরাঁর সবগুলোই এখন বন্ধ। পর্যটনকেন্দ্র রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে গত বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে পর্যটকদের এতই চাপ ছিল যে ভ্রমণের জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাওয়া যেত না। অথচ এখন কোথাও কোনো পর্যটক নেই। নৌকা নিয়ে সারা দিন ঘাটে বসে থেকেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে নৌযানচালকদের। পর্যটন করপোরেশনের তালিকাভুক্ত বোট মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁদের সমিতির ৯২টি বোটের প্রতিটির ভাড়া ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সমিতির প্রতিদিনের আয় ছিল এক লাখ টাকা। এখন বোটের চালকদের সারা দিন বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই। একজন পর্যটকেরও দেখা মেলে না। রাঙামাটির পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিন বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে। রাঙামাটি পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা জানান, পর্যটকের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়তে থাকায় গত বছর ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি চারতলা মোটেল নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৩০ লাখ টাকা খরচ করে ঝুলন্ত সেতু ও মোটেলের বিভিন্ন স্থান সংস্কার করা হয়। এত কিছু করে কোনো লাভই হলো না। হরতাল-অবরোধের কারণে কোনো আয়ই হচ্ছে না। সিলেটের জাফলং, শ্রীপুর, জৈন্তা রাজবাড়ী, নীল জলের নদীখ্যাত লালাখাল, শাহজালাল ও শাহ পরানের মাজার; সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এবং মৌলভীবাজারের দৃষ্টিনন্দন চা-বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রভাত ও হাকালুকি হাওরে এ সময়টায় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। গত বছরও এমন সময়ে এসব স্থানে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের সরব পদচারণ ছিল। এবার ১ শতাংশ পর্যটকও আসছেন না। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত কুয়াকাটায় এখন কলাপাড়া কিংবা পার্শ্ববর্তী এলাকার হাতেগোনা কিছু লোকজন ছাড়া দূরের কোনো পর্যটক নেই। সৈকত ও এর আশপাশের আকর্ষণীয় স্পটগুলো নির্জন পড়ে আছে। সৈকতের জিরো পয়েন্টে পর্যটকদের জন্য বিছানো ছাতাগুলো ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তিরা নিজেরাই এসব ছাতার নিচে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। ভ্রমণ ও বুকিং বাতিল হচ্ছে: টোয়াব সূত্র বলছে, ২৬ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ১৭ জনের একটি পর্যটক দলের এ দেশে বেড়ানোর কথা ছিল। তারা বুকিং বাতিল করেছে। ১৭ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনের ৫০ জনের একটি বড় পর্যটক দলের ভ্রমণের কথা থাকলেও তাও বাতিল হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্যের চারজনের একটি পর্যটক দলও তাদের ভ্রমণ বাতিল করেছে। ভ্রমণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান জার্নি প্লাসের প্রধান নির্বাহী তৌফিক রহমান জানান, এ পর্যন্ত শুধু তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বুকিং দেওয়া ১২০ জন বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ বাতিল করেছেন। এতে তাঁর দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
No comments:
Post a Comment