Monday, January 19, 2015

সীমাবদ্ধতায় শৃংখলিত স্বাধীন কমিশন:যুগান্তর

পৃথক পৃথক আইনের আওতায় গঠিত হলেও মেরুদণ্ডহীন হয়ে আছে দেশের স্বাধীন কমিশনগুলো। কিছু ক্ষেত্রে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করার মানসিকতা পোষণ করছে না। আবার কিছু ক্ষেত্রে আইনি সীমাবদ্ধতা ও সরকারের আন্তরিকতার অভাবে অকার্যকর হয়ে আছে। নামে স্বাধীন কমিশন হলেও একটি কমিশনও জনস্বার্থে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না। এ জন্য আইনি দুর্বলতা, আর্থিক নির্ভরশীলতা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় কমিশন প্রধানদের নিয়োগ দেয়াসহ নানা কারণ রয়েছে
বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বাধীন কমিশনগুলোর দুরবস্থার পেছনে চারটি কারণ তুলে ধরে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘যেসব আইনের আওতায় কমিশনগুলো গঠিত, সে আইনেই ক্ষমতা কম দেয়া হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবেই কমিশনগুলোকে দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত : এসব কমিশনের ক্ষেত্রে সরকারের অর্থ বরাদ্দ কম থাকে। এটাও তাদের দুর্বল হওয়ার অন্যতম কারণ। তৃতীয়ত : দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে কমিশনগুলোর চেয়ারম্যান বা সদস্য নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এবং চতুর্থত : জাতি গঠনে ও দেশের স্বার্থে এ ধরনের কমিশনের গুরুত্ব, অবদান সম্পর্কে যারা সরকার চালান তাদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। যতদিন এসব কমিশন দুর্বল থাকবে ততদিন দেশ দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে উঠতে বা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে না বলে মনে করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ। আইন কমিশন : ১৯৯৬ সালে আইন কমিশন প্রতিষ্ঠা করে সরকার। কমিশনের মূল কাজ- পুরনো আইনের সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে আইনটি যুগোপযোগী ও জনকল্যাণকর করে তোলা। এ ছাড়া অকার্যকর আইন বাতিলের এবং নতুন আইন প্রবর্তনের জন্য সরকারকে সুপারিশ করা, আইনের অপব্যবহার রোধে সুপারিশ করা, বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়নে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করা, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাসমূহ নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণসমূহ চিহ্নিতকরণ, আদালত ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক নিয়ে সুপারিশ, আইনগত সহায়তা কার্যক্রম কীভাবে কার্যকর করা যায় সে ব্যাপারে সুপারিশ, সরকার কোনো বিষয়ে আইনগত মতামত চেয়ে পাঠালে তা প্রদান করা উল্লেখযোগ্য। প্রায় ১৮ বছর আগে গঠিত এ কমিশন থেকে এ পর্যন্ত আইনের পরিবর্তন, পরিমার্জনসংক্রান্ত ১৩২টি সুপারিশ পাঠানো হয়েছে সরকারের কাছে। কিন্তু দু-একটি ছাড়া কোনো সুপারিশই আমলে নেয়নি সরকার। আইন কমিশন আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন কোনো প্রতিবেদন চূড়ান্ত করলে তা সরকারের কাছে পেশ করবে এবং সরকার প্রতিবছর সংসদের প্রথম অধিবেশনে ওই সুপারিশ বাস্তবায়নসম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন পেশ করবে।’ কিন্তু এ আইন শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বলেন, ‘আমাদের যেটুকু দায়িত্ব আমরা তা পালন করি। আইনে আছে সুপারিশ পাঠিয়ে দেয়ার, আমরা তা করছি। এরপর সরকার কি করবে না করবে তা সরকারের ব্যাপার, আমরা তো আর সরকারের উপরে না।’ কমিশনের দুরবস্থা ফুটে ওঠে এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড থেকেই। গত ২৯ ডিসেম্বর আইন কমিশন সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে একজন সদস্যের সঙ্গে মতবিরোধের জের ধরে মাঝপথেই সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন এর চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক। কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ আলমের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওই সংবাদ সম্মেলনে গত এক বছরের কাজের বিবরণ উপস্থাপন করার পর চেয়ারম্যান খায়রুল হকের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান এ পর্যন্ত যেসব সুপারিশ পাঠানো হয়েছে তার কি কি সরকার বাস্তবায়ন করেছে? জবাবে খায়রুল হক বলেন, ‘সেটা আপনারা সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন। আমার কাছে কোনো ফিডব্যাক নেই। তবে আমি ফিডব্যাক প্রত্যাশা করি।’ এ পর্যায়ে কমিশনের সদস্য ড. শাহ আলম বলেন, ‘গত ৬ বছর ধরে আমি এখানে কর্মরত। এ সময়ের মধ্যে ৩৯টি সুপারিশ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইন অনুযায়ী এগুলো তারা সংসদে পাঠাতে বাধ্য। কিন্তু একটি সুপারিশও তারা পাঠায়নি।’ এ সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আইন কমিশনে নিয়োগ পাওয়া খায়রুল হক বলেন, ‘এটা তার (শাহ আলম) ব্যক্তিগত মত, কমিশনের নয়।’ তখন শাহ আলম বলেন, এটা মতামতের বিষয় নয়। সাংবাদিকরা যে তথ্য জানতে চেয়েছেন আমি সে তথ্যই উপস্থাপন করেছি। এখানে মতামত দেয়ার কিছু নেই। এ পর্যায়ে বিচারপতি খায়রুল হক ক্ষুব্ধ হয়ে সংবাদ সম্মেলন থেকে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) : বিশ্বিবিদ্যালয় শিক্ষার সংবিধিবদ্ধ শীর্ষ সংস্থা হিসেবে ইউজিসির উদ্দেশ্য হচ্ছে- উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো ও শক্তিশালী করা। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রমের মান ঠিক রাখাও মুখ্য বিষয়। এর আরও লক্ষ্য হচ্ছে- একাডেমিক শৃংখলা, অর্থনৈতিক জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় গুণগত উন্নয়ন সাধন। কিন্তু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে ও গুণগত মান বজায় রাখতে প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ভূমিকা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। ঘটছে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের মতো ঘটনা। প্রতিটি সেশনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাত্রছাত্রী ভর্তির নিয়ম থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা মানছে না। একটির বেশি ক্যাম্পাস না রাখা, নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকার বিষয়ে আইন থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা মানা হচ্ছে না। এসব বিষয়ে দেখভালের দায়িত্ব ইউজিসির। সেই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে সংস্থাটি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন-২০০৪-এর অধীনে গঠিত বর্তমান দুদক। এ কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে সমাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে অনেকটাই ব্যর্থ কমিশন। দুদকের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে প্রায় চার হাজার। যার একটিও চূড়ান্ত বিচারে প্রমাণিত হয়নি। একমাত্র ‘বনখেকো’ ওসমান গনি দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল না করে কারাভোগ করছেন স্বেচ্ছায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিশনের এ অবস্থার পেছনে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং প্রসিকিউশনের দুর্বলতাসহ রয়েছে নানা কারণ। জানতে চাইলে দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা অনেককে জেলে ঢুকিয়েছি। ডেসটিনি, হলমার্ক, রেলে নিয়োগ-দুর্নীতিসহ অনেক ঘটনায় অনেকেই এখনও জেলে রয়েছে। অনেককে সাজা দিয়েছি। আমাদের মামলায় ৪৭ শতাংশ সাজা পেয়েছে। যেখানে পুলিশের মামলায় সাজার রেট ১০ শতাংশ।’ চূড়ান্ত পর্যায়ে কারও সাজা বহাল না থাকার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘সেটা হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের ব্যাপার। আমরা তো শুধু জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারি। এরপর বিচারের দায়িত্ব জজদের।’ ওয়ান-ইলেভেনে যারা জেলে ঢুকেছিল তারা সবাই বের হয়ে গেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা সফল। এই সফলতা আশানুরূপ না হলেও আমরা হতাশ নই।’ এক দশকের মূল্যায়নে দেখা যায়, জন্মলগ্ন থেকেই দুদক ছিল আমলাদের করায়ত্তে। নানাভাবে এটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। যখনই সক্রিয় হল তখন থেকে এটি পরিণত হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ারে। আইনত ‘স্বাধীন’ হলেও কার্যক্রমে সরকার এবং দুদক ছিল একাট্টা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন : জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেশের জনগণের মানবাধিকার রক্ষার এক বড় আশা-ভরসারস্থল। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এ কমিশন নিজেই অসহায়। সরকারের কাছে সুপারিশ আর তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই কমিশনের। কেউ বা কোনো কর্তৃপক্ষ কমিশনের আদেশ না মানলে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানাতে পারে তারা। এ অসহায়ত্বের কথা নিজেই স্বীকার করেন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কোনো সরকারি অফিসকে কমিশন থেকে কোনো কথা বললে তা ওই অফিসের জন্য পালন বাধ্যতামূলক নয়। আইনে বাধ্যবাধকতা নেই। নিজস্ব তদন্ত ক্ষমতার জন্য আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন। আর প্রবল রাজনৈতিক ইচ্ছা না থাকলে এটা হবে না।’ তথ্য কমিশন : তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তথ্য কমিশন। এ আইনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট এনজিও’র কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আইনেই এ কমিশনকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। কমিশনে নিয়োগ, তথ্য অধিকার বাস্তবায়নে এর সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। আইন জারির ৬০ দিনের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা নিয়োগের কথা থাকলেও দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছরেও অনেক প্রতিষ্ঠানে এ নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি। নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটির ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ রয়েছে। আইনের ৭ ধারায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহকে এ আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া তথ্য না দিলে কারও বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে এ কমিশনের আইনে। জানতে চাইলে সাবেক তথ্য কমিশনার প্রফেসর সাদিকা হালিম যুগান্তরকে বলেন, তথ্য কমিশন আইনের ধারা ৭ ও ধারা ৩২ তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে আছে। ৭ ধারায় বলা আছে, ২০টি বিষয়ে তথ্য দেয়া যাবে না।  

No comments:

Post a Comment