Saturday, January 24, 2015

জীবন রক্ষাকারী ওষুধও অবরুদ্ধ:কালের কন্ঠ

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত লুৎফর রহমান (৬২) চিকিৎসকের পরামর্শে প্রতিদিন দুই বেলা সেবন করেন সিটাগ্লিপটিন ও মেটফরমিন জেনেরিকের ওষুধ। দু-এক দিন ওষুধ বাদ গেলেই ডায়াবেটিসের মাত্রা যায় বেড়ে, অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধের কারণে ৯ দিন ধরে ওই দুটি ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর এলাকার ফার্মেসিগুলোতে। বাধ্য হয়ে ঢাকায় তাঁর এক আত্মীয়র সঙ্গে যোগাযোগ করে ওষুধ দুটি সংগ্রহের
চেষ্টা করেন। ওই আত্মীয় নিকটস্থ ফার্মেসিতে গিয়ে শোনেন, কাঁচামাল না থাকায় কয়েক দিন ধরে কম্পানি ওই ওষুধ দুটি উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারছে না। গত মঙ্গলবার লুৎফর রহমান উৎকণ্ঠার সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নির্ধারিত ওষুধ না পেয়ে ইনস্যুলিন নিচ্ছিলাম। কিন্তু দুই দিন ধরে ইনস্যুলিনও পাওয়া যাচ্ছে না। জানি না, আমার কী অবস্থা হবে!' লুৎফর রহমানের ঘটনাটি বগুড়া শহরের। ওদিকে যশোরের ওষুধ বাজারে সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে ইনহেলারের। ঠাণ্ডায় এ ওষুধের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও ঢাকা থেকে তা ঠিকমতো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। হরতাল-অবরোধের কারণে জরুরি ওষুধ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ওষুধ কম্পানি ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। এভাবে সারা দেশেই ওষুধের স্বাভাবিক জোগান অনেক কমে গেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে রোগীদের ওপর। জরুরি ওষুধ প্রয়োজন মতো না পেয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছে রোগীরা। আরেক দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে ওষুধ প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ওষুধ উৎপাদনের অনেক কাঁচামালের স্বাভাবিক সরবরাহ না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন, আর উৎপাদন করতে না পারায় বাজারজাত করাও সম্ভব হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো ওষুধের উৎপাদন ও মজুদ থাকলেও সংশ্লিষ্ট কম্পানি তা সারা দেশে সরবরাহ করতে পারছে না পথের ঝুঁকির কারণে। জরুরি ওষুধের পরিবহনেও ঘটছে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা। 'জরুরি ওষুধ সরবরাহ' লেখা ব্যানার থাকা সত্ত্বেও হামলা করা হচ্ছে এসব পরিবহনে। রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রথম সারির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অবরোধের মুখে আমাদের ওষুধ সরবরাহ ৫০ শতাংশ কমে গেছে। রাজশাহী, ফেনী ও ঢাকার টঙ্গী এলাকায় জরুরি ওষুধবোঝাই ছয়টি ডেলিভারি ভ্যান ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে একটিতে। ফলে আমরা সন্ত্রস্ত। বাধ্য হয়ে সরবরাহ অনেকটাই কমিয়ে দিতে হয়েছে। আবার রোগীরা হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে গিয়ে স্বাভাবিক সময়ের মতো চিকিৎসা নিতে না পারায় ওষুধের চাহিদাও কমে গেছে।' আরেক ওষুধ কম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, 'হামলার ভয়ের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে ওষুধ সরবরাহ করতে চাইলে পরিবহন মালিকরা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া দাবি করছেন। অনেক কম্পানির পক্ষেই এমন অবস্থা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বরং লাভের চেয়ে লোকসানের আশঙ্কা ও পথের ঝুঁকি এড়াতে অনেক কম্পানি ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।' র‌্যাংগস ফার্মাসিউটিক্যালস সূত্র জানায়, কুমিল্লায় নিজেদের একটি পরিবহনে করে স্থানীয় বাজারে ওষুধ সরবরাহকালে একদল অবরোধকারী ওই পরিবহন অবরোধ করে বিপুলসংখ্যক ওষুধ লুট করে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য সমঝোতার মাধ্যমে কিছু ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে। অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রউফ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ওষুধ সরবরাহব্যবস্থা মারাত্মক সংকটে পড়েছে। হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের আশঙ্কায় ওষুধ পাঠানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে জরুরি চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ খাতকে রাজনৈতিক সহিসংতার বাইরে রাখার আহ্বান জানান দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির। উদ্বেগ ও আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, 'কাকে বলব বা বোঝাব আমাদের দৈন্যদশার কথা! সবারই তো বিষয়টি জানা আছে যে, জরুরি ওষুধকে যেকোনো আন্দোলন কর্মসূচির বাইরে রাখা উচিত। কারণ এটা মানুষের জীবন রক্ষার অবলম্বন। ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে বা ওষুধ ক্ষতিগ্রস্ত করে কোথাও কোনো কর্মকাণ্ড হয় না; হতে পারে না। অথচ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ অবরোধের সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বহু ওষুধবোঝাই পরিবহনে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।' ওষুধ শিল্প মালিকদের এই নেতা বলেন, 'অবরোধের ফলে আমাদের এ খাতের উৎপাদন ও সরবরাহ সবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর্থিক হিসাবে গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে আমাদের। আপাত দৃষ্টিতে এই ক্ষতিকে অল্প মনে হলেও এটাই এই শিল্প খাতের মূল চালিকা শক্তি। কারণ আমরা যে শত শত কোটি টাকা মূলধন খাটিয়ে এ সেক্টরকে টিকিয়ে রাখছি, সেখান থেকে আমরা এই সামান্য অংশটুকুই মুনাফা করতে পারি। কিন্তু যখন ওই লাভের অংশটুকুও হারাতে হয় তখন আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।' এর চেয়েও বড় ক্ষতি বা সমস্যার শিকার হচ্ছে রোগীরা। যেসব রোগী নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে জীবন বাঁচিয়ে রাখছে, প্রয়োজনীয় ওষুধ না পেয়ে তারা এখন পড়েছে ঝুঁকির মুখে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রোগীদের এমন ভোগান্তি ও ঝুঁকির খবর পাঠিয়েছেন কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকরা। বরিশাল নগরীর বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়কের (বিবির পুকুর) ম্যাক্স মেডিসিনের স্বত্বাধিকারী রিয়াজুল হোসেন রবিন কালের কণ্ঠকে বলেন, অবরোধের কারণে রোগীরা গ্রাম থেকে শহরে আসে না। তাই ওষুধ বিকিকিনি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। চাহিদা না থাকায় নতুন করে অর্ডার দেওয়া হয় না, আবার ঢাকা থেকেও ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। লাগাতার অবরোধে স্বাভাবিক সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় ময়মনসিংহের দোকানগুলোতে কিছু কিছু ওষুধ পাওয়াই যাচ্ছে না। ময়মনসিংহ শহরের দুর্গাবাড়ী সড়কের মেডিক্যাল মার্টের আবদুল্লাহ আল মনসুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সংকট প্রকট হয়ে উঠতে পারে। বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের যশোরের সিনিয়র মেডিক্যাল প্রমোশন এক্সিকিউটিভ কাজী মাশরুল ইসলাম বলেন, 'হরতাল-অবরোধের কারণে আমাদের ওষুধ সরবরাহের গাড়ির সংখ্যা কমাতে হয়েছে। বাজারে কোনো কোনো ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে সেই ওষুধ সরবরাহের জন্য ঢাকায় বলা হয়েছে।' রাজশাহী নগরীর ওষুধপট্টি বলে পরিচিত লক্ষ্মীপুর এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ওষুধের দোকানগুলোতেও বেচাকেনা কমে গেছে। আবার ঠিকমতো গাড়ি আসতে না পারায় কোনো কোনো কম্পানির ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে কিছু ব্যবসায়ী ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায় করছে। ওল্ড রাজশাহী ফার্মেসির মালিক ডলার মাহমুদ বলেন, টানা অবরোধ ও মাঝে মাঝে হরতালের কারণে ওষুধের চাহিদা অনেকটা কমে গেছে; বেচাকেনাও কমে গেছে। (প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন যশোর থেকে ফখরে আলম, ময়মনসিংহ থেকে নিয়ামুল কবির সজল, রাজশাহী থেকে রফিকুল ইসলাম ও বরিশাল থেকে রফিকুল ইসলাম)।      

No comments:

Post a Comment