দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনা, সভা-সমাবেশ, বিরোধী রাজনৈতিক দলের লাগাতার হরতাল-অবরোধের হুমকি, পেশাজীবী, শিল্প-কলকারখানার মালিক ও ব্যবসায়ী সমাজের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আপত্তি কোনো কিছুকেই আমলে নিচ্ছে না সরকার। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছেই। চলতি মাসে শুরু করবে দাম বৃদ্ধি প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের পরিষ্কার বক্তব্য বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয়
করা হবে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শুনানির জন্য প্রস্তুত। ২০ জানুয়ারি পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং পরদিন সঞ্চালন দাম বৃদ্ধির ওপর শুনানি হবে। পরে ২২ ও ২৫ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি প্রস্তাবের ওপর শুনানি হবে। এরপরই আসবে চূড়ান্ত ঘোষণা। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, দুর্নীতি-টাকা পাচার আর লুটপাটের জন্য সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। এটা কার্যকর করা হলে লাগামহীন হয়ে যাবে নিত্যপণ্যের মূল্য। বেড়ে যাবে গণপরিবহন ভাড়া। উৎপাদন খরচ বাড়বে। সরকারের উল্টো তেলের দাম কমানো উচিত। পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, লুটপাটের জন্যই মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে। কিন্তু দেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। এই মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল হচ্ছে লুটপাটের আখড়া। আর দাম বাড়লে এ লুটপাট আরও বেড়ে যাবে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির এ উদ্যোগ সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে। কৃষি-শিল্প পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। নিত্যপণ্যের দাম আরও এক ধাপ বাড়বে। এতে জনগণের বিশেষ করে নিু ও মধ্যবিত্তের জীবন ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে উঠবে। বিইআরসির চেয়ারম্যান এআর খান বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর ২০ জানুয়ারি গণশুনানি শুরু হবে। মূল্যবৃদ্ধি করা হবে কিনা- শুনানি শেষে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। অপরদিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনাকে গাঁজাখোরি প্রস্তাব বলে উল্লেখ করেছেন তিতাস গ্যাসের শেয়ারহোল্ডাররা। সম্প্রতি তিতাস গ্যাসের বার্ষিক সাধারণ সভায় তারা আবাসিক খাতে দুই চুলার দাম এক লাফে ১ হাজার টাকা করার তীব্র বিরোধিতা করেন। চলতি মাসের শেষদিকে কিংবা ফেব্র“য়ারির শুরুতে গ্রাহকদের জন্য মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে সরবরাহ করায় কোম্পানিগুলোর লোকসান বাড়বে। ক্ষতি কমাতে হয় দাম বাড়াতে হবে, না হয় সরকারকে বাড়তি অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দিতে হবে। পেট্রোবাংলার অধীনস্থ ৬ কোম্পানি সব ধরনের গ্যাসের দাম ১১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। আর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গত মাসে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ১৮.১২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। উভয় ক্ষেত্রে জানুয়ারি থেকে দাম বৃদ্ধি কার্যকরে আবেদন করা হয়। সব ধরনের গ্যাসের দাম বাড়ছে : বিইআরসি সূত্র জানায়, সব কোম্পানি একই হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন বলে যুক্তি দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্র্রিবিউশন কোম্পানি লি., বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্র্রিবিউশন কোম্পানি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্র্রিবিউশন কোম্পানি এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি প্রত্যেকে পৃথক প্রস্তাব দিয়েছে। কোম্পানিগুলো ১ জানুয়ারি থেকে গ্যাসের নতুন দাম কার্যকর করার আবেদন করেছে। আবেদনে আবাসিক খাতে এক চুলার গ্যাসের দাম ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা এবং দুই চুলা ৪৫০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবাসিকে মিটার ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে প্রতি হাজার ঘনফুট ১৪৬ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩৫ টাকা বা ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট (এক হাজার কিউবিক ফুট) ১১৮ টাকা ২৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৪০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য ২৬৮ টাকা ০৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ টাকা, শিল্প গ্রাহকদের জন্য ১৬৫ টাকা ৯১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২২০ টাকা, চা শিল্পে ১৬৫ টাকা ৯১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা এবং সার কারখানায় ৭২ টাকা ৯২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনের গ্যাসের পাইকারি দাম প্রতি হাজার ঘনফুট ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩২ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাধারণের প্রতি হাজার ঘনফুট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে জ্বালানিমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করার অনুমোদন চাওয়া হয়। ওই সময় তারা একটি প্রাথমিক প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়। সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করার অনুমোদন দেন। এর আগে সর্বশেষ ২০০৯ সালে নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়। এরপর সিএনজির মূল্য কয়েক ধাপে সমন্বয় করা হলেও শিল্প, আবাসিক ও অন্যান্য খাতের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। বাড়ছে পাইকারি বিদ্যুতের দাম : গত অক্টোবরে পিডিবি বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠায় বিইআরসিতে। এতে প্রতি ইউনিটে (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) ০.৮১ টাকা কমিশনের কাছে সুপারিশ করেছে পিডিবি। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ইউনিটপ্রতি ৪.৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৫.৫১ টাকা হবে। ১ জানুয়ারি থেকে বর্ধিত হার কার্যকর করার সুপারিশ করেছিল পিডিবি। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৬.৫৪ টাকা। এতে প্রতি ইউনিটে পিডিবির লোকসান হচ্ছে ১.৮৪ টাকা। গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়বে : খুচরা অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়বে বিদ্যুতের। পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে চারটিই ইতিমধ্যে বিইআরসির কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে পিডিবি প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম গড়ে ২২ শতাংশ, ওজোপাডিকো সাড়ে ১৮ শতাংশ, আরইবি সাড়ে ১৫ শতাংশ, ডেসকো ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ আর ডিপিডিসি সাড়ে ১৭ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। বিইআরসি সূত্র জানায়, পিডিবির প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়ানো হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম বর্তমানের চার টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে পাঁচ টাকা ৫১ পয়সা হবে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ৬ টাকা ৫৪ পয়সা। তাই দাম বাড়ানো হলেও উৎপাদন ব্যয় ও পাইকারি বিক্রির মধ্যে প্রতি ইউনিটে ব্যবধান থাকবে এক টাকা তিন পয়সা। এ ব্যবধান ঘোচানোর জন্য সরকারকে বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এখন দিতে হচ্ছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০১৪ সালের মার্চে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়। সে সময় ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্য গড়ে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তাতে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের গড় দাম পড়ছে প্রায় সাড়ে ৫ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য সরকারের গত মেয়াদে ছয় দফায় ২ টাকা ৩৭ পয়সা থেকে ৯৮ দশমিক ৩১ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়ানো হয়। আর গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্য গড়ে ৪ টাকা থেকে ৫৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের মার্চে মূল্যবৃদ্ধি হয়।
No comments:
Post a Comment