Friday, January 30, 2015

মালয়েশিয়া যাওয়ার ‘স্বপ্ন’ কুতুবদিয়ায় বিলীন:প্রথম অালো

দালাল টাকা মেরে দেবে—এমন ঝুঁকি ছিল না। ঝুঁকি ছিল শুধু উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার। একটুখানি সচ্ছলতার আশায় ট্রলারে কয়েক ঘণ্টার ওই সমুদ্রযাত্রাকে তাই ‘তুচ্ছ’ ঘটনা মনে হয়েছিল কাউসারের কাছে। সাগরে ট্রলারডুবিতে নারায়ণগঞ্জের কাউসারের মালয়েশিয়ার ‘স্বপ্ন’ হোঁচট খেয়েছে কুতুবদিয়ায়। অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবিতে অন্তত ৩০ জন যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার খুদিয়ারটেক চ্যানেলে ৭০-৮০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও পুলিশের সহায়তায় ৪৩ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের একজন নারায়ণগঞ্জের কাউসার (২০)। কুতুবদিয়া থানায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, মালয়েশিয়ায় যাওয়ার বিষয়ে তাঁদের সাতজনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার এক দালালের চুক্তি হয়। ঠিক হয় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর প্রত্যেকে দালালকে দুই লাখ টাকা করে দেবেন। বুধবার সকালে তাঁরা সাতজন চট্টগ্রামে আসেন। রাতে তাঁদের ট্রলারে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে তুলে দেওয়া হয়। ট্রলারডুবিতে সাতজনের মধ্যে পাঁচজন উদ্ধার হয়েছেন। দুজন এখনো নিখোঁজ। কাউসার বলেন, ‘ট্রলারে সমুদ্রযাত্রা এত ভয়ংকর হবে, এটি আগে বুঝিনি। এভাবে যাতে আর কেউ না যায়।’ পুলিশ সূত্র জানায়, গত তিন বছরে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাচারকালে বঙ্গোপসাগরে চারটি ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন ৫০০ জন। এই সময় নারী, শিশুসহ ৫০ যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। গতকাল ভোরে ট্রলারটি ডুবে যাওয়ার পরই যাত্রীদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করেন কোস্টগার্ডের কুতুবদিয়া স্টেশনের সদস্যরা। দুপুরের দিকে অভিযানে যোগ দেয় কোস্টগার্ডের দুটি জাহাজ ‘তৌহিদ’ ও ‘তানভীর’ এবং নৌবাহিনীর জাহাজ ‘অতন্দ্র’ ও ‘অপরাজেয়’। এ ছাড়া নৌবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারও অভিযানে অংশ নেয়। সন্ধ্যায় ডুবে যাওয়া ট্রলারটি টেনে তীরের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। তবে দুপুরের পর আর কোনো যাত্রীকে উদ্ধার করা যায়নি। কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) তোফায়েল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীদের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মালয়েশিয়াগামী যাত্রীবোঝাই ট্রলারটি ডুবোচরে আটকে অথবা সাগর চ্যানেলে স্রোতের ঘূর্ণিপাকে উল্টে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোস্টগার্ড ও পুলিশ দুপুর পর্যন্ত কুতুবদিয়া উপকূল থেকে ৩২ এবং মহেশখালীর মাতারবাড়ী উপকূল থেকে ১১ জনকে উদ্ধার করেছে। নিখোঁজ অন্য যাত্রীদের উদ্ধারে তৎপরতা চলছে। তিনি জানান, উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের বাড়ি নরসিংদী, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বগুড়া, মাদারীপুর, যশোর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়। তোফায়েল আহমদ জানান, চলতি মাসের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের অভিযানে কক্সবাজার উপকূল এলাকা থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে ৩৯ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় অাটক করা হয় ১৬ দালালকে। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ১ হাজার ৩০০ যাত্রীকে মালয়েশিয়া পাচারকালে উদ্ধার করা হয়। কুতুবদিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার হওয়া ৩২ যাত্রীকে প্রথমে থানায় নিয়ে আসা হয়। তাঁদের বয়স ১৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। অসুস্থ হয়ে পড়ায় সাতজন যাত্রীকে চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার ও কুতুবদিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ও উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা জানান, বুধবার রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট এলাকা থেকে মাঝারি আকারের একটি ট্রলারে করে ৭০-৮০ জন যাত্রী সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। প্রায় চার ঘণ্টা চলার পর ট্রলারটি থামানো হয়। এ সময় একটি ছোট ট্রলার আসে। দালালেরা তাঁদের এফবি ইদ্রিস নামে মাছ ধরার একটি ছোট ট্রলারে উঠতে বলেন। কিন্তু ছোট ট্রলারে উঠতে যাত্রীরা অাপত্তি জানান। এ সময় তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। এরপর সবাই ছোট ট্রলারটিতে ওঠেন। এক-দেড় ঘণ্টা চলার পর ট্রলারটি হঠাৎ কাত হয়ে ডুবে যেতে থাকে। যাত্রীদের অনেকেই ট্রলারে থাকা কাঠসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম আঁকড়ে এবং সাঁতরে বাঁচার চেষ্টা করেন। অন্য নৌকা ও ট্রলার এসে তাঁদের অনেককে উদ্ধার করে। মাতারবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম জানান, দুপুর ১২টার দিকে ১১ জন যাত্রী সাগর সাঁতরিয়ে মাতারবাড়ীর ষাইটপাড়া উপকূলে ওঠেন। এরপর পুলিশ উদ্ধার করে তাঁদের ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন। উদ্ধার যাত্রীরা হলেন শাহেদুল ইসলাম (২২), মোহাম্মদ জিন্নাহ (২৫), মো. আজাহার (৪৫), মোহাম্মদ ছবুর (২৩), মো. অহিদ (২৮), রফিক আলী (২২), শাহ আলম (২৩), নুরুজ্জামান (২৯), মো. তৈয়ব (৩২), মোহাম্মদ রাশেল (২৭) ও নুরুল কবির (২৫)। তাঁদের বাড়ি যশোর, নওগাঁ, মাদারীপুর, সিলেট ও নরসিংদী জেলায়। যাত্রী শাহেদুল ইসলাম ও আজাহার গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, বুধবার রাতে গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ থাইল্যান্ডের একটি জাহাজে তাঁদের তুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে ট্রলারটি ডুবোচরে আটকে উল্টে যায়। একটি খালি ড্রাম নিয়ে ভাসতে ভাসতে তাঁরা মাতারবাড়ীর ষাইটপাড়ায় পৌঁছান। ট্রলারের আরেক যাত্রী যশোরের ইয়াছিন হোসেন জানান, তাঁরা ১১ জন মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দালালের সঙ্গে চুক্তি করেন। ১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা করে দালালকে দেওয়ার কথা রয়েছে। কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আংসাই থোয়াই প্রথম আলোকে বলেন, ৪৩ যাত্রী ছাড়া ওই ট্রলারের নিখোঁজ অন্যদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রীদের হিসাব মতে, ট্রলারে ২০ জনের বেশি নিখোঁজ থাকতে পারেন। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে চারজনকে পাচারকারী সন্দেহে আটক করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment