Tuesday, January 20, 2015

দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে বিমানের জেদ্দা স্টেশন:যুগান্তর

বাংলাদেশ বিমানের জেদ্দা অফিসের কান্ট্রি ম্যানেজার ও জিএসএ (জেনারেল সেলস এজেন্ট) এলাফ এভিয়েশনের বিরুদ্ধে ১৩৩ কোটি টাকা লোপাট ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্টেশন ম্যানেজার আবু তাহের বিমানের প্রধান কার্যালয়ের একজন পরিচালক ও একজন জেনারেল ম্যানেজারের যোগসাজশে পুরো টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটিয়েছেন। সংস্থার অভ্যন্তরীণ তদন্তে প্রাথমিকভাবে এ অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে বিমান সূত্রে জানা গেছে। বিমানের পরিচালক (প
্রশাসন) রাজপতি সরকার যুগান্তরকে বলেন, জেদ্দা অফিস নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের অভিযোগ পাওয়ার পরপরই ম্যানেজমেন্ট তদন্ত করবে। এর আগে বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজার আমিনুলের (সাবেক ভূমিমন্ত্রীর জামাতা) বিরুদ্ধে এ ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। তার বিরুদ্ধে প্রায় ৭৮০ কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিমানের সেক্টরভিত্তিক হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিক এ ধরনের বড় দুর্নীতির সংখ্যা হাতেগোনা। দুটি ঘটনায় বিমানজুড়ে তোলপাড় চলছে। ইতিমধ্যে বিমানের জেদ্দাস্থ কান্ট্রি ম্যানেজার আবু তাহেরকে জেদ্দা স্টেশন থেকে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিমান। পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতি ও আবু তাহেরকে সহায়তার অভিযোগে জিএসএ এলাফ এভিয়েশনের সঙ্গে বিমানের চুক্তি বাতিলেরও চিন্তাভাবনা চলছে। এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট জেনারেল ম্যানেজারকেও এ মামলায় অভিযুক্ত করা হবে। বিমানের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, জিএসএ এলাফের নিয়োগ নিয়েও কোটি কোটি টাকার আন্ডার হ্যান্ড ডিলিংয়ের অভিযোগ ছিল। কিন্তু তৎকালীন দুই বোর্ড মেম্বার, বিমানের সাবেক এমডি কেভিন স্টিল ও দুই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকায় এলাফ এভিয়েশনকে তখন জিএসএ থেকে বাদ দেয়া সম্ভব হয়নি। বিমান সূত্র জানায়, জেদ্দার বর্তমান কান্ট্রি ম্যানেজার আবু তাহের কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। অভিযোগ, নামে-বেনামে ভুয়া বিল-ভাউচার করে তিনি গত ২ বছরে একশ’ থেকে দেড়শ’ কোটি টাকার বেশি লোপাট করেছেন। এ ছাড়া নির্ধারিত ওজনের অতিরিক্ত ব্যাগেজ বহন করে, বয়স্ক টিকিট ইস্যু করে অপ্রাপ্ত যাত্রীদের বয়স্ক দেখিয়ে, মার্কিন ডলারের পরিবর্তে সৌদি রিয়ালে বিক্রয়কৃত অর্থ স্থানান্তর, বিলম্বিত ফ্লাইটের যাত্রীদের গ্রাউন্ড ফিডিং প্রদান করে, ক্রুদের হোটেল বিলে অনিয়ম, দায়িত্বপ্রাপ্ত হ্যান্ডলিং এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যাগেজ হারানোর কথা বলে যাত্রীদের ভুয়া ক্ষতিপূরণ প্রদান, ডিপোর্টি প্যাসেঞ্জারদের (গলাকাটা পাসপোর্টে আসা) ভাড়া, অস্থায়ী ও ক্যাজুয়াল ক্রুদের সিঙ্গেল রুম বরাদ্দ দিয়ে বছরে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করছেন। এ ছাড়া আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ম্যানেজমেন্টের অনুমোদন ছাড়াই সৌদি আরবে চিকিৎসা না করিয়ে ব্যাংককে গিয়ে চিকিৎসার নামে ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের ঘটনায় বিমানের চিফ মেডিকেল অফিসারের ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু আবু তাহের সেটা না করে এমনকি ছুটি না নিয়ে ব্যাংকক গিয়ে ২ মাসের বেশি সময় অবস্থান করেছেন। এ অভিযোগে বিমান ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্ষদ তার বিল আটকে দিলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে জেদ্দাস্থ এলাফ এভিয়েশনের কাছ থেকে পুরো টাকা নিয়ে নেন। অভিযোগ আছে, জিএসএ এলাফকে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ দিয়ে আবু তাহের প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকা মাসোয়ারা নিচ্ছেন। এলাফের সঙ্গে চুক্তিকালীন সময়ে সিকিউরিটি মানি হিসেবে বিমানের ফান্ডে ১৫ মিলিয়ন রিয়াল অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা জামানত রাখা হয়েছিল। বিমান এ টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে মাসে গড়ে ৩০ লাখ টাকা আয় করত। কিন্তু আবু তাহের বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই গোপনে সাবেক এমডির সঙ্গে যোগসাজশে জামানতের টাকা ১৫ মিলিয়ন থেকে ৫ মিলিয়ন কমিয়ে দেন। এ ঘটনায় বছরে বিমান প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এ কাজটি করতে আবু তাহের এলাফের পক্ষে যেসব যুক্তি ও তথ্য তুলে ধরেছিলেন সেগুলোর অধিকাংশই ছিল ভুয়া ও মিথ্যা। আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে তিনি ২০১৪ সালে হজ শেষে মক্কা ও মদিনাতে হাজীদের মালামাল সংগ্রহের জন্য একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেন। ২০১৩ সালে প্রতিটি লাগেজের ওজন ধরা হয়েছিল ৩০ কেজি। কিন্তু আবু তাহের এবার সেই ওজন বাড়িয়ে ৪০ কেজি করেন। এ খাতে বিমান প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে। অভিযোগ, গত বছর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সৌদি সফরকালে জেদ্দা বিমানবন্দরে আবু তাহেরকে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছিল। এ ছাড়া ফ্লাইট ডিলের তথ্য অগ্রিম না জানানোর কারণে একটি বিশেষ বাহিনীর প্রধান জেদ্দা বিমানবন্দরে এসে ৫ ঘণ্টার উপরে বসে ছিলেন। এ সময় আবু তাহেরকে টেলিফোন করে কোথাও পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায়ও আবু তাহেরকে শোকজ করা হয়। জানা গেছে, আবু তাহের এতটাই প্রভাবশালী, তার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ থাকলেও তাকে জেদ্দা স্টেশন থেকে দীর্ঘদিন ধরে সরানো হচ্ছে না। একই অভিযোগ আছে দুবাইয়ের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ এহসান হোসেন কাজী, নিউইয়র্কের কান্ট্রি ম্যানেজার আশরাফ হোসেন, নেপালের কান্ট্রি ম্যানেজার মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে। দুবাইয়ের কান্ট্রি ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সেখানে বিমানের কাজ না করে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করছেন। তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২শ’ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভিযোগের কোনো তদন্ত করছে না বিমান। অপরদিকে ঢাকা-নিউইয়র্কের কোনো ফ্লাইট না থাকলেও গত ৫ বছর ধরে আশরাফ হোসেনকে নিউইয়র্কের কান্ট্রি ম্যানেজার করে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দিয়ে আসছে বিমান। বিমানের মার্কেটিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অদক্ষ, অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত জেনারেল সেলস এজেন্টের (জিএসএ) কারণে গত ৫ বছরে শুধু জেদ্দা ও লন্ডনের দুটি রুট চালিয়ে বিমান লোকসান গুনছে ৯শ’ কোটি টাকার বেশি। অভিযোগ, তারা বিমানের নামে যাত্রী সংগ্রহ করে শেষ মুহূর্তে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সেসব যাত্রী অন্য এয়ার লাইন্সের কাছে বিক্রি করে দিত। হিসাব অনুযায়ী ২০১২-১৩ সালে বিমান ঢাকা-লন্ডন-রোম-মিলানসহ পুরো ইউরোপ রুটে লোকসান দিয়েছে ২৩২ কোটি টাকা। অপরদিকে ঢাকা-জেদ্দা-রিয়াদসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট চালিয়ে বিমানকে লোকসান গুনতে হয়েছে ৩৯৪ কোটি টাকা। তবে মার্কেটিং সূত্রে জানা গেছে, গত ২-৩ মাস ধরে বিমানের লন্ডন ও জেদ্দা রুটে লাভ হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, জেদ্দার এলাফ এভিয়েশনের সঙ্গে বিমানের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও প্রায় এক বছর কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই তারা বেআইনিভাবে টিকিট বিক্রি করেছে। মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক শাহনেওয়াজ জানান, বিভিন্ন অভিযোগে লন্ডনের কার্গো জিএসএ আনা এভিয়েশনকে বাদ দিলেও জেদ্দার এলাফ এভিয়েশনকে বাদ দেয়া সম্ভব হয়নি। সূত্র জানায়, জেদ্দার বর্তমান জিএসএ’র অধিকাংশ স্টাফ হচ্ছে পাকিস্তানের নাগরিক। এর আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ওই জিএসএ’র কর্মকাণ্ডগুলো কঠোর মনিটরিং করার জন্য বিমানকে রিপোর্ট দিয়েছিল। কিন্তু বিমানের মার্কেটিং বিভাগ এ বিষয়টির কোনো পাত্তা দেয়নি। এ প্রসঙ্গে বিমান পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, তিনি এখন অফিসিয়ালি বিমানের চেয়ারম্যান নন। কাজেই এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারবেন না। তবে চেয়ারম্যান থাকাকালীন জিএসএ নিয়োগের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেন, আগে বছরের পর বছর বিমানের জিএসএ অপারেটরদের চুক্তি শেষে শুধু নবায়ন করা হতো। কোনো টেন্ডার আহ্বান করা হতো না। তার নির্দেশনার পর এখন মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে। এতে বিমান বড় ধরনের লাভবান হচ্ছে। জেদ্দার স্টেশন ম্যানেজার আবু তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ খণ্ডন করা হয়েছে।  

No comments:

Post a Comment