Monday, January 12, 2015

অবরোধে স্থবির চট্টগ্রাম:যুগান্তর

নতুন বছরের শুরুতেই রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পরিবহন সীমিত হয়ে পড়ায় পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির জন্য সৃষ্ট এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে শিল্প, পর্যটন, নৌপরিবহন, সড়ক পরিবহন, কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বল
ে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক থাকলেও সেখান থেকে খালাস হওয়া পণ্য বিভিন্ন স্থানে ডেলিভারি দেয়া যাচ্ছে না। পুলিশ-বিজিবি পাহারায় কিছু কিছু যান চলাচল করলেও অধিকাংশ পণ্যের চালানই আটকা পড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে যেসব যানবাহন পণ্য নিয়ে দূরপাল্লার রুটে যাত্রা করছে, তারা ভাড়া নিচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। বন্দর বহির্নোঙর মাদারভেসেল থেকে পণ্য বোঝাই কয়েকশ’ লাইটার জাহাজ সদরঘাট থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত ঘাটে অলস বসে আছে। পরিবহন না থাকায় জাহাজগুলো পণ্য খালাস করতে পারছে না। আবার ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে রফতানি পণ্য ভর্তি কন্টেইনার নিয়ে লরি বন্দরে আসতে না পারা এবং তৈরি পোশাকের শিপমেন্ট করতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেখানে দৈনিক ৭/৮ হাজার যানবাহন চলাচল করে সেখানে রোববার বিকাল পর্যন্ত ৪ দিনে আইনশৃংখলা বাহিনীর পাহারায় যানবাহন চলাচল করেছে মাত্র ১ হাজার ৭৮০টি। একইভাবে পর্যটনের ভরা মৌসুমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যেখানে দৈনিক কয়েক হাজার যানবাহন চলাচল করে সেখানে পুলিশ পাহারায় তিন দিনে চলাচল করেছে মাত্র ২০৪টি যান। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে শনিবার যুগান্তরকে বলেন, হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে। অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক না থাকায় শিল্প উৎপাদন এবং রফতানি খাত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি পণ্য খালাস হলেও স্বাভাবিক গতিতে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে পারছে না। বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু কিছু যানবাহন পণ্য নিয়ে যেতে রাজি হলেও তারা তিন-চারগুণ বেশি ভাড়া দাবি করছে। বস্ত্র ও গার্মেন্ট খাত : টানা অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি খাত বস্ত্র ও পোশাক শিল্প। এ শিল্পের পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ক্রেতার কাছে যথাসময়ে পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। ট্রাকসহ পরিবহন সংস্থাগুলো তাদের ভাড়া পাঁচগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া বিদেশে ইমেজ সংকটও তৈরি হচ্ছে। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, প্রতি দিন ৫৫০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হচ্ছে। হরতালে এসব পণ্য রফতানি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ঝুঁকির মধ্যে পণ্য নিয়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ চার-পাঁচগুণ বেশি পড়ছে। আবার রফতানি পণ্য বেসরকারি আইসিডিতে রাখলে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া গুণতে হয়। নৌ এবং বিমানযোগে পরিবহনের ক্ষেত্রে ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। এ হিসাবে বস্ত্র ও গার্মেন্ট খাতে ক্ষতির পরিমাণ দৈনিক ২৫০ কোটি টাকা। বিজিএমইএর পোর্ট অ্যান্ড শিপিংবিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, রফতানি খাত এখন চ্যলেঞ্জ মোকাবেলা করছে। তাজরীন ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর এমনিতেই পোশাক খাতের অবস্থা নাজুক। তিনি বলেন, একদিকে রফতানি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে দাম কমছে। এতে প্রতিযোগিতার বাজারে এমনিতেই চাপের মুখে রফতানিকারকরা। বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি এরশাদ উল্লাহ বলেন, টানা অবরোধে দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে গার্মেন্ট সেক্টরের। তিনি বলেন, পুলিশ পাহারায় কতদিন যানবাহন চালানো যাবে- এ জন্য প্রয়োজন স্থায়ী একটি সমাধান। চাকতাই-খাতুনগঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের ভোগ্যপণ্যের প্রধান বাজার চাকতাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যও। চাকতাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের হিসাব মতে, ব্যাংক ঋণের বিপরীতে উচ্চ হারে সুদ, গুদামে মালামাল পচে নষ্ট, কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচসহ দৈনিক ২০ শতাংশ খরচ গুণতে হচ্ছে। এক দিনের হরতাল অবরোধে দৈনিক প্রায় তিনশ’ কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। চাকতাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এসএম হারুনুর রশিদ জানান, স্বাভাবিকভাবে দিনের বেলায় চট্টগ্রাম বন্দর ও দেশের বিভিন্ন গুদাম থেকে পণ্য নিয়ে দুই-তিনশ’ ট্রাক চাকতাইয়ে প্রবেশ করে। আবার বিক্রি করা পণ্য নিয়েও দেশের বিভিন্ন স্থানে যায় শত শত ট্রাক। পরিবহনের জন্য প্রতি দিন ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি ভ্যান ঢোকে তিন শতাধিক। একই সঙ্গে নৌপথে চাকতাই খাল দিয়ে প্রায় শতাধিক নৌযানে প্রতি দিন পণ্য আনা-নেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে অনেক মজুর। হরতালে ট্রাক, নৌযান, ঠেলা ও ভ্যানচালক মিলে কয়েক হাজার শ্রমিকও বেকার সময় কাটান। খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগির আহমদ জানান, খাতুনগঞ্জে চার সহস্রাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতে দৈনিক ৯-১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। হরতাল-অবরোধে লেনদেন সীমিত হয়ে পড়ে। এ কারণে ৫ জানুয়ারির পর থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সুদ, কর্মচারীদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ মিলে প্রায় ২০ শতাংশ হারে লোকসান গুণতে হয় ব্যবসায়ীদের। একদিনে প্রায় তিনশ’ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ ব্যবসায়ী নেতা। পরিবহন খাত : হরতাল-অবরোধে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবহন খাত। মহাসড়কে নাশকতার আশকায় বন্ধ রয়েছে মালামাল ও যাত্রী পরিবহন। ফলে চরম লোকসানের মধ্যে পড়েছে পরিবহন খাত। সীমিত পরিসরে ঝুঁকি নিয়ে যেসব যানবাহন চলাচল করছে তাদের ভাড়া বাবদ গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মনির আহমেদ যুগান্তরকে জানান, চট্টগ্রামে মালামাল পরিবহনে ৮ থেকে ১০ হাজার কাভার্ডভ্যান রয়েছে- যার অধিকাংশই এখন অলস বসে আছে। যেগুলো ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহন করছে, সেক্ষেত্রে প্রতি গাড়িতে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে। পর্যটন শিল্প : হরতাল, অবরোধ আর চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের পর্যটন খাত মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে টানা অবরোধের কারণে বিকাশমান পর্যটন শিল্পটি বারবার ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। টানা অবরোধের কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে আশংকাজনকভাবে কমে গেছে পর্যটক। এছাড়া খালি পড়ে আছে দেশের শতাধিক পর্যটন অঞ্চল ও এর হোটেল মোটেল রিসোর্ট। হোটেল মোটেল মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, টানা অবরোধের কারণে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ কোটি টাকা। ফলে অবরোধের কারণে শুধু কক্সবাজারে ক্ষতির পরিমাণ ২৫ কোটি টাকার বেশি। চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙ্গামাটিসহ এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার যুগান্তরকে জানান, হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত প্রায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে চার শতাধিক হোটেল মোটেল ও গেস্ট হাউসকে বেশ কয়েক দিন ধরে লোকসান গুণতে হচ্ছে। টানা অবরোধের কারণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি টাকার বেশি। পর্যটক কমে যাওয়ায় এরই মধ্যে শহরের দু’শতাধিক হোটেল মোটেল ও গেস্ট হাউস বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার পথে আরও অনেক হোটেল মোটেল। কৃষি খাত : এখন রবি শস্যের ভরা মৌসুম। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত আলু, বেগুন, মরিচ, শসা, শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, লাউ, গাজরসহ শীতকালীন শাকসবজি বাজারজাত করে তাদের উৎপাদন খরচ মিটিয়ে সংসারের অন্যান্য কাজের জন্য কিছু বিক্রি করেন। কিন্তু অবরোধের কারণে পরিবহন ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয়ায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত হাজার হাজার টন শাকসবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। অর্ধেকেরও কম মূল্যে তাদের ফসল বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। চট্টগ্রামে শাকসবজির বাজারে দৈনিক ২০ কোটি টাকার ওপরে যে লেনদেন হতো সেটি এখন এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।  

No comments:

Post a Comment