Wednesday, January 21, 2015

পাইকারি বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কমানোর দাবি:যুগান্তর

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির গণশুনানির শুরুর দিনেই তোপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিতরণ কোম্পানিগুলোর ত্র“টিপূর্ণ প্রস্তাব ও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ নিুগামী হওয়ার পরও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির শুনানি শুরু করায় বিইআরসিকে সরকারের দালাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন শুনানি অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য, এখন বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কোনো ধরনের যৌক্তিকতা
নেই। একইসঙ্গে মূল্য বৃদ্ধির জন্য কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির প্রস্তাবিত সুপারিশও ত্র“টিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে এ প্রস্তাবনাটি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়ার দাবি জানিয়ে পাইকারি বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন। শুনানিতে বক্তারা বলেছেন, লুটপাট করার জন্যই মূলত বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। গাঁজা খেয়ে তারা এ মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। তাদের বক্তব্য- যেখানে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে সেখানে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এক ধরনের গাঁজাখোরি প্রস্তাব। বক্তারা বলেন, কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি, বেসরকারি ও আমদানিকৃত বিদ্যুৎ পৃথক পৃথকভাবে না দেখিয়ে একসঙ্গে করা হয়েছে। এতে করে সুপারিশের মধ্যেও শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। পাশাপাশি তেলের দামের নিুগতিও এই হিসেবে আনা হয়নি। পিডিবির গত ছয় মাসের হিসাব জমা দিতে বলা হলেও জমা দেয়নি। এমনকি গণশুনানিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ালে খুচরা বিদ্যুতের দামও বাড়বে। এতে সামগ্রিক অর্থনীতি ও জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মঙ্গলবার বিইআরসির সম্মেলন কক্ষে পাইকারি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির শুনানি অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে পিডিবির পক্ষ থেকে পাইকারি বিদ্যুতের বর্তমান গড় মূল্য চার টাকা ৬৭ পয়সা থেকে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ বা ৮৫ পয়সা বৃদ্ধি করে ৫ টাকা ৫২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবের ওপর কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বা ২২ পয়সা বাড়িয়ে চার টাকা ৮৯ পয়সা করার সুপারিশ করেছে। গণশুনানি শেষ করে বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আগামী ১০ ফেব্র“য়ারি চূড়ান্ত রায় দেয়া হবে। আর দাম বাড়লে কার্যকর হবে ১ ফেব্র“য়ারি থেকে। কারওয়ান বাজারের টিসিবি অডিটরিয়ামে গণশুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান এআর খান সভাপতিত্ব করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, মো. মকসুদুল হক, রহমান মুরশেদ। অপরদিকে শুনানিতে বক্তব্য রাখেন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম, বিজিএমইএ’র সচিব কাজী শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশসহ বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানি, ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা। তবে অনুষ্ঠানে বিপিসির কোনো প্রতিনিধি অংশ না নেয়ার কারণে পিডিবি কি দামে বর্তমানে তেল ক্রয় করছে এবং কতটুকু করছে এর কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। পিডিবির পক্ষে গণশুনানিতে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে এক হাজার কোটি টাকার মতো লোকসান হবে। সরকার পিডিবিকে কোনো ভর্তুকি দেয় না। ৩ শতাংশ হারে এ প্রতিষ্ঠানটি সরকারের বাজেট বরাদ্দ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। এ কারণে প্রতিবছরই বাড়ছে দেনা। ইতিমধ্যে পিডিবির দেনার পরিমাণ তার মোট সম্পদের সীমা অতিক্রম করেছে। ফলে দাম না বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। এ অবস্থায় পিডিবিকে পাইকারি দাম বৃদ্ধির পক্ষে আরও অধিকতর যুক্তি থাকলে তা কাল বৃহস্পতিবারের বিইআরসিতে জমা দেয়ার জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান এআর খান নির্দেশ দিয়েছেন। গণশুনানিতে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, কোনোবারই ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে পারেনি পিডিবি। অথচ দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে তারা ২০ শতাংশ দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এবারও তারা প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে ১২ শতাংশ। অথচ এবারও প্রবৃদ্ধি থাকবে ৯ শতাংশের মধ্যে। তিনি আরও বলেন, এরকম বহু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যারা বছরে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করেনি কিন্তু তারা বিদ্যুতের বিল নিয়ে গেছে। তাদের নাম পর্যন্ত বলার সাহস নেই পিডিবির। সেই না দেয়া বিদ্যুতের কারণে পিডিবি লোকসানে পড়ছে। এদিকে বিইআরসিতে যখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি চলছিল তখন এর বাইরে গণঅবস্থান করে বিক্ষোভ করেছে বাম মোর্চা। মোর্চাভুক্ত সংগঠন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মাহবুব) ও গণসংহতি আন্দোলনের নেতারা গণঅবস্থানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। তারা বলেন, গত আট মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিু পর্যায়ে রয়েছে। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। গণশুনানিতে অংশ নেয়া জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর আগে গত দুইবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে পিডিবি ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল ২০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাবে। অথচ এ সময় পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশের কিছু বেশি। এক্ষেত্রে পিডিবি তাদের নতুন দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে ১০ শতাংশ কম প্রবৃদ্ধির অর্থ কোথায় গেল তা উল্লেখ করেনি। তারা বলেছেন, এ প্রস্তাবটি শুধু ত্র“টিপূর্ণই নয়, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও প্রহসন। প্রস্তাবটি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিয়ে উল্টো বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবি জানান। উল্লেখ্য, গত দুই ও চলতি অর্থবছরে বাজেটে পিডিবির জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। তবে এ টাকা ভর্তুকি হিসেবে পিডিবিকে দেয়া হয়নি। উল্টো ৩ শতাংশ সুদে চুক্তিতে দলিলে সই করে পিডিবিকে অর্থ নিতে হয়েছে। এর ফলে প্রতিবছরই পিডিবি আসল সুদের হার বাড়ছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রতিবছর বিদ্যুতে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।  

No comments:

Post a Comment