সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্রদের আবাসিক হলে প্রায় ৯৩ শতাংশ ছাত্রই থাকছেন অবৈধভাবে। তাঁরা হলের ভর্তি ফি দেন না। তবে ছাত্রী হলে শতভাগই থাকছেন বৈধভাবে। কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ের পরে হলের ভর্তি ফি দিলে ছাত্রীদের গুনতে হয় জরিমানা। ছাত্রদের তিনটি হলই এখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। হলে ভর্তি না হয়েও ছাত্রলীগের নেতাদের মাধ্যমে ছাত্ররা অবৈধভাবে হলে উঠছেন। এ বি
ষয়ে হল প্রশাসনও নীরব। ভর্তি ফি অনেক কমে যাওয়ায় ছাত্র হলগুলো অর্থসংকটে পড়েছে। হলগুলোর নথি, হল প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। গত ২০ নভেম্বর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সংগঠনের এক কর্মী নিহত হওয়ার পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। ওই সংঘর্ষের আগের এক সপ্তাহ তিনটি ছাত্র হল ও দুটি ছাত্রী হলে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো আসন খালি নেই। তবে কাগজে-কলমে শাহপরান হলে ৪৪৭টি আসনের মধ্যে ৭০টিতে, বঙ্গবন্ধু হলের ৫০৮ আসনের মধ্যে ৫৮টিতে ভর্তি হওয়া ছাত্র রয়েছেন। বাকি আসনগুলোর ছাত্ররা হলে থাকছেন অবৈধভাবে। সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ৬৪টি আসনের কোনোটিতেই ভর্তি হওয়া ছাত্র নেই। ছাত্রীদের হলের সবাই থাকছেন বৈধভাবে। পরে ৬ ও ৭ জানুয়ারি হলগুলোতে গিয়ে নথি ঘেঁটে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হলে বৈধ বাসিন্দা আছেন মাত্র ১৯ জন, অর্থাৎ ৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। শাহপরান হলে ৫৫ জন, অর্থাৎ ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। সৈয়দ মুজতবা আলী হলে বৈধ শূন্য শতাংশ। ছাত্রীদের দুটি হল শহীদজননী জাহানারা ইমাম হল ও বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের শতভাগ বাসিন্দাই বৈধ। ভর্তি না হয়েও হলে থাকা কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলগুলো ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে হলে উঠেছেন। ছাত্রলীগের মিছিলে গেলে হলে থাকায় সমস্যা নেই। তাঁদের কেউ কেউ দুই বছর ধরে এভাবে হলে থাকছেন। হল প্রশাসন কখনো তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ বা হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ছাত্ররা জানান, এভাবে থাকতে পেরে তাঁরাও হলে ভর্তি ফি দিয়ে বৈধ হওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। হলের নথি ঘেঁটে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের পর হলগুলোতে অবৈধভাবে থাকার হার এখন সবচেয়ে বেশি। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্র হলগুলোতে বৈধভাবে থাকা শিক্ষার্থীর হার ছিল ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হল থেকে বের করে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ নেয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির। ২০০৪ সাল পর্যন্ত¯ হলে বৈধভাবে ছিলেন ৭০ শতাংশ। এর পর থেকে এই হার কমতে থাকে। ২০০৮ সালে হলে বৈধভাবে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০-৫৫ শতাংশে নামে। ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতায় এলে হলগুলো ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তবে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত¯ হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তৎপরতায় বৈধ আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর হলে বৈধভাবে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে কমতে এখন ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। হল সূত্র জানায়, হলে আসন শূন্য থাকা সাপেক্ষে গত বছর মুজতবা আলী হল ও শাহপরান হল জানুয়ারি ও জুনে, বঙ্গবন্ধু হল তিন দফায় ছাত্র ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে বঙ্গবন্ধু হলে ১৯ জন ও শাহপরান হলে ৫৫ জন আবেদন করেন। তাঁরা ভর্তি ফি দিয়ে হলে বৈধভাবে ওঠেন। এক বছরের জন্য হলে ভর্তি ফি ১ হাজার ৭০০ টাকা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এলাকা ও বাসাভেদে মাসিক মেসভাড়া জনপ্রতি ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা। এ ছাড়া হলে থাকলে ডাইনিংয়ে কম দামে খাবারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। এ জন্য হলে থাকার চাহিদা বেশি। তবে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে মেসে থাকতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের সারোয়ার তুষার বলেন, ‘অল্প খরচ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্য হলে থাকতে চাই। কিন্তু হলে কোনো ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীনভাবে থাকার পরিবেশ নাই। তাই হলে থাকি না।’ ছাত্রদের হল প্রশাসন সূত্র জানায়, ভর্তি ফি বাবদ পাওয়া টাকায় হলের প্রায় সব খরচ চালানো হতো। এখন অধিকাংশ ছাত্র ভর্তি ফি না দেওয়ায় হলের আয় অনেক কমে গেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রতিটি হলে নিয়মিত ভর্তুকির পাশাপাশি মাসে ৩০ হাজার টাকা অনুদান দিতে হচ্ছে। অনুদানের টাকায় ডাইনিংয়ের কর্মচারীদের বেতন দিয়ে কোনোমতে হল চালু রাখা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্র হল প্রশাসনের কয়েকজন জানান, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কারণে হলে ছাত্র ভর্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তাঁদের একজন বলেন, হল প্রশাসন কার্যত ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষ মো. আবদুল গণি বলেন, ‘সমস্যাগুলো এত জটিল যে এককভাবে হল প্রাধ্যক্ষের পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কেন্দ্রীয়ভাবে নৈতিক অবস্থান নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে।’ শাহপরান হলের প্রাধ্যক্ষ আশরাফুল আলম বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে ছাত্ররা ভর্তি বা পুনঃভর্তি হতে পারেননি। হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় হলে শুধু বৈধ আবাসিক ছাত্রদের অবস্থান নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে।’ সৈয়দ মুজতবা আলী হলের প্রাধ্যক্ষ মো. ফারুক উদ্দিন বলেন, ‘হলে ছাত্র ভর্তি নিশ্চিত করতে সবাইকে ডেকেছিলাম। তাঁদের কয়েকজন জানিয়েছেন, হল প্রশাসনের বাইরে অন্য জায়গায় তাঁদের টাকা দিতে হয়। তাই তাঁরা ভর্তি হতে পারবেন না। শিগগির মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হলে ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ ভর্তি ফি না দিয়ে ছাত্রলীগের মাধ্যমে হলে ওঠা, থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি অঞ্জন রায় বলেন, ‘ছাত্রলীগের প্রভাবে নয়, বরং হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় হলে বৈধ ছাত্র কমেছে। প্রশাসন বছরে একটা দায়সারা নোটিশ দিয়ে সারা বছর আর খবর রাখে না। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও হলে ভর্তি হতে চান।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হলে কোনো কারণে ভর্তি ফি নির্ধারিত সময়ে দিতে না পারলে ছাত্রীদের সময়ভেদে ১০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হয়। শহীদজননী জাহানারা ইমাম হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ মাহরুবা শারমিন চৌধুরী ও বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ রাজিয়া সুলতানা চৌধুরী শতভাগ ছাত্রীর ভর্তি ফি দিয়ে হলে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘হল প্রশাসনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিন্ডিকেট বৈঠকের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আগে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
No comments:
Post a Comment