Wednesday, January 7, 2015

কৃষকের মাথায় হাত:প্রথম অালো

আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতা। আবারও কৃষকের মাথায় হাত, লোকসানের বোঝা! ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে সরকার ও বিএনপির পাল্টাপাল্টা রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকেরা পড়েছেন বিপাকে। বিশেষ করে সবজিচাষিরা। একদিকে চাষিরা সবজির ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের কাঁচাবাজারে সরবরাহ-সংকটের অজুহাতে বেড়ে গেছে সবজির দাম। ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষও। গত কয়েক দিনের রাজনৈ
তিক অস্থিরতায় বিপুল পরিমাণ সবজি নষ্ট হয়েছে মোকামে ও মাঠে। রাতারাতি সবজির দামও পড়ে গেছে। ঝুঁকি নিয়ে অবরোধের মধ্যে ট্রাক বের করছেন না মালিকেরা। এতে দেখা দিয়েছে ট্রাকসংকট। আর যাঁরা সবজি পরিবহনে আগ্রহী, তাঁরা হাঁকছেন বাড়তি ভাড়া। দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম সবজিবাজার মহাস্থানগড়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রতি কেজি ফুলকপি বিক্রি হয়েছে এক টাকায়। আর রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি ফুলকপি বিক্রি হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। বগুড়া জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক চণ্ডীদাস কুণ্ডু বলেছেন, ‘এবার জেলায় প্রতি কেজি ফুলকপি উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে চার টাকা। সেই হিসাবে যদি এক টাকায় ফুলকপি বিক্রি করা হয়, তাহলে প্রতি কেজিতে কৃষকের লোকসান তিন টাকা।’ বাঁধাকপির বেলায়ও একই অবস্থা। বগুড়ার কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি বাঁধাকপি উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে চার থেকে পাঁচ টাকা। আর গতকাল মহাস্থান বাজারে প্রতিটি বাঁধাকপিও বিক্রি হয়েছে মাত্র এক টাকায়। তাতেও ক্রেতা মেলেনি। আর বিপুল লোকসানের ভয় এখন কৃষকের চোখেমুখে। ক্ষুব্ধও তাঁরা। বগুড়ার গোকুল গ্রামের কৃষক তাহের উদ্দিনের কণ্ঠে ক্ষোভ। তাঁর ভাষায়, ‘লেতারা তো অবরোধ দিয়্যা ঘরত বসে এসি খাচ্চে, জান বাইর হয়্যা যাচ্চে খালি হামাকেরে।’ কৃষিতে সমৃদ্ধ জনপদ পাবনার ঈশ্বরদীতে গতকাল প্রতি মণ বেগুন বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। অথচ গত রোববারও প্রতি মণ বেগুনের দাম ছিল ৪৩০ টাকা। কৃষকেরা জানিয়েছেন, প্রতি মণ বেগুন উৎপাদনে খরচ হয়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি মণ বেগুন বিক্রি করে কৃষকের লোকসান দাঁড়াচ্ছে ১৭০ থেকে ২২০ টাকা। দেশজুড়ে বিখ্যাত ঈশ্বরদীর পেয়ারা। এ বছর ফলনও হয়েছে ভালো। কিন্তু ভালো দাম তো দূরে থাক, উৎপাদন খরচ পাবেন কি না, তা নিয়েও চাষিরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কারণ, এক দিনের ব্যবধানে পেয়ারার দাম মণপ্রতি দুই হাজার টাকা কমে গতকাল দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকায়। জয়পুরহাটে বিঘাপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা লোকসান দিয়ে এই মুহূর্তে আগাম জাতের আলু বিক্রি করতে হচ্ছে চাষিদের। জেলার বিভিন্ন বাজারে গতকাল সাদা হল্যান্ড জাতের প্রতি মণ গ্র্যানোলা আলু ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা ও লাল পাকরি জাতের আলু ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কয়েক দিন আগেও এসব আলু প্রতি মণ পাঁচ শ থেকে সাড়ে পাঁচ শ টাকায় বিক্রি হয়। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও কয়েক মাসের টানা রাজনৈতিক সহিংসতায় বিপুল লোকসান গুনতে হয় কৃষকদের। সেই লোকসান কাটিয়ে ওঠার আগে আবারও নতুন করে কৃষকদের লোকসানে ফেলেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ার মহাস্থানগড়ে গতকাল বিক্রি করতে না পেরে অনেক কৃষক সবজি ফেলে দিয়েছেন। একই অবস্থা মেহেরপুর, যশোর, ঈশ্বরদী, জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন সবজির বাজারে। ৪ থেকে ৬ জানুয়ারি—তিন দিনে শুধু মেহেরপুর থেকে দেড় শ সবজিবাহী ট্রাক ঢাকায় আসতে পারেনি। এর ফলে প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন সবজিচাষি ও ব্যবসায়ীরা। জেলার সবজিপণ্য পরিবহন সমিতির সভাপতি হাফিজুর রহমান জানান, তিন দিনে প্রায় ১ হাজার ৮০০ টন সবজি ঢাকায় পাঠানো যায়নি। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন মেহেরপুর থেকে ৫০-৬০ ট্রাকবোঝাই সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে যায়। সেখানে গত তিন দিনে কোনো ট্রাক ঢাকায় যায়নি। একই অবস্থা বগুড়ার মহাস্থানগড়েও। এখানকার পাইকারি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান এস ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে মহাস্থানগড় বাজার থেকে সবজিবোঝাই ২০ থেকে ৩০টি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। গতকাল গেছে মাত্র চার-পাঁচটি ট্রাক। তাও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা বেশি ভাড়ায়। কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে যত সবজিবাহী ট্রাক আসছে, গত সোমবার রাতে আসছে তার অর্ধেকের কম। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ ট্রাক আসে, সেখানে সোমবার এসেছে দেড় শর মতো ট্রাক। ভাড়াও বেশি। এমনিতে বগুড়া থেকে ১৫ হাজার টাকায় ট্রাক এলেও অবরোধের কারণে এই ভাড়া ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। {প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আনোয়ার পারভেজ (বগুড়া), মনিরুল ইসলাম (যশোর), মাহবুবুল হক (ঈশ্বরদী), তুহিন আরন্য (মেহেরপুর), আসাদুল ইসলাম (জয়পুরহাট)}

No comments:

Post a Comment