Friday, January 9, 2015

মুসল্লিরাও অবরুদ্ধ!:কালের কন্ঠ

শীতের রাতে ঘন কুয়াশার মধ্যেও ব্যাগ, কাপড়ের পুঁটলি মাথায় কিংবা হাতে নিয়ে বের হতে হয়েছে রাস্তায়। রাতে বাস চলছে শুনে রাস্তায় অপেক্ষা শুরু করেন। কিন্তু বাস না পেয়ে কেউ সি
এনজি অটোরিকশায় ওঠেন। কেউ বা ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করেন। কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অপেক্ষার প্রহর গুনে বাসে উঠে দুরু দুরু বুকে পথ চলেন। এ ধরনের নানামুখী দুর্ভোগের পথ পাড়ি দিয়ে মুসল্লিরা জড়ো হয়েছেন তুরাগ নদের তীরে- টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার মাঠে। মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্মেলন বিশ্ব ইজতেমা আজ শুরু হচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের তৃতীয় দিনের অবরোধে পথের কষ্ট তুচ্ছ করে তুরাগ তীরে উপস্থিত হতেই তাঁদের চোখে-মুখে ফুটেছে খুশির ঝিলিক। তবে বিভিন্ন সীমান্তে ভিসা জটিলতায় আটকে পড়েছেন বিদেশি মুসল্লিরা। সীমান্ত পাড়ি দিতে পারলেও বাসের অভাবে তাঁদের কারো কারো ইজতেমায় অংশ নেওয়া আর হচ্ছে না। অবরোধের কারণে ইজতেমায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা ইজতেমার আগে অবরোধ তুলে নেওয়ার আশা করলেও গতকাল ঝুঁকির মধ্যেই গাড়ি রাস্তায় নামাতে হয়েছে তাদের। শিল্প শহর টঙ্গীর তুরাগপারে আজ শুরু হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্ব শেষ হলে চার দিন বিরতি দিয়ে ১৬ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে রাজধানীসহ ৩২ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে বিশ্ব ইজতেমার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ইজতেমার প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জিম্মাদার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ জানান, দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা কয়েক দিন ধরে ময়দানে আসছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানে আসা বিদেশি অতিথিদের অনেকেই ঢাকার কাকরাইল মসজিদে এসে আগেই অবস্থান নিয়েছেন। যাঁরা এখন আসছেন তাঁদের ইজতেমার নিজস্ব যানবাহনে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ময়দানে নিয়ে আসা হচ্ছে। অবরোধের কারণে দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকলেও ট্রেন, ট্রাক, লঞ্চ ও বিকল্প ব্যবস্থায় মুসল্লিরা ইজতেমায় যোগ দিচ্ছেন। এবারের ইজতেমায় পাঁচ স্তরের কঠিন নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আগতদের যাবতীয় সেবা প্রদানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রাজধানীর প্রধান তিনটি বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল করেছে বিক্ষিপ্তভাবে। তবে ট্রেন ও নৌপথে ফিরে এসেছে যাত্রী পরিবহনের স্বাভাবিক চিত্র। মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস চলাচল সীমিত থাকলেও রাজধানীতে গতকাল দিনভর স্থানে স্থানে যানজট ছিল। তাতে কারোরই মনে হয়নি রাজধানীতে কোনো অবরোধ আছে। তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইজতেমায় অংশ নিতে আগেই প্রস্তুতি নেওয়া হাজার হাজার মুসল্লি অবরোধের কারণে হঠাৎ করেই বড় বিপদে পড়েন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন- বিআরটিসি মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য ২২৮টি একতলা ও দোতলা বাসের বিশেষ সেবা চালু করেছে। ট্রেনেও পরিবহন করা হবে মুসল্লিদের। কিন্তু দূরপাল্লার বাস চলাচল সীমিত থাকায় তাঁদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আগের দুই দিনের তুলনায় গতকাল সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের দূরপাল্লার বাস রাজধানীতে বেশি আসে। আগের রাতেও রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন রুটে বাস চলাচল করে। শ্যামলী পরিবহন, হানিফ পরিবহন ও ইউনিক পরিবহনের মতো অভিজাত কম্পানির বাসগুলোও চলাচল করেছে। সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী থেকে কিছু নরমাল শ্রেণির বাসও ছেড়ে গেছে বিভিন্ন জেলায়। সদরঘাটে রাজধানীমুখী লঞ্চে যাত্রী চাপ ছিল বেশি। বিড়ম্বনায় মুসল্লিরা : টঙ্গী থেকে আমাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধি মো. মাহবুবুল আলম জানান, বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে মুসল্লিদের নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গতকাল সকালে ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জেলা থেকে বাস না পেয়ে ট্রাক ও পিক-আপে মুসল্লিরা আসছেন। কনকনে শীত আর ঠাণ্ডা বাতাসে উন্মুক্ত এসব যানবাহনে আসা বয়স্ক মুসল্লিদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নরসিংদীর বেলাব থেকে আসা জামাতের মুসল্লি লোকমান হোসেন বলেন, খোলা ট্রাকে আসতে গিয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে তাঁদের খুব কষ্ট হয়েছে। গাড়িতে ভাড়া তিনগুণ দাবি করায় তাঁরা ট্রাকে এসেছেন। শেরপুর থেকে আসা মুসল্লি হাফিজুর রহমান, কামাল হোসেন ও রাজিউর রহমান বলেন, তাঁরা গভীর রাতে রিজার্ভ বাস নিয়ে এসেছেন। ভাড়া আগের চেয়ে দ্বিগুণ। কিশোরগঞ্জ থেকে আসা মুসল্লি হাবিবউল্লাহ বলেন, বাসে নিরাপত্তা না থাকায় তাঁরা ট্রাক নিয়ে এসেছেন। রাজধানী ও আশপাশে লোকাল বাস চলাচল করায় এসব এলাকার মুসল্লিরা সহজে আসতে পারছেন, কিন্তু অপেক্ষাকৃত দূরের জেলাগুলোর মুসল্লিরা ট্রেনে আসছেন। সকালে টঙ্গী রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ট্রেনগুলোর ভেতর তিল ধারণের স্থান নেই। গাইবান্ধা থেকে মাওলানা আমান উল্লাহর নিয়ে আসা জামাতের মুসল্লিরা জানান, পথে পথে যানবাহন বদল করে করে তাঁদের আসতে হয়েছে। কয়েক স্থানে গাড়িতে ঢিল ছোঁড়া হয়েছে। নড়াইল থেকে আসা জামাতের মুসল্লি সোবহান মিয়া বলেন, এভাবে অবরোধ চলতে থাকলে তাঁরা কিভাবে আবার বাড়ি ফিরবেন তা নিয়ে ভাবনায় আছেন। মোনাজাতের পর তো আর গাড়িই পাবেন না বলে মন্তব্য তাঁর। প্রথম পর্বে যে ৩২ জেলা : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে অংশ নিচ্ছেন ৩২ জেলার মুসল্লি। তাঁদের জন্য রয়েছে নির্ধারিত ৪০টি খেত্তা। গাজীপুর (১, ২ খেত্তা), ঢাকা (৩ থেকে ১৩ নম্বর খেত্তা), সিরাজগঞ্জ (১৪), নরসিংদী (১৫), ফরিদপুর (১৬), রাজবাড়ী (১৭), শরিয়তপুর (১৮), কিশোরগঞ্জ (১৯), নাটোর (২০), রংপুর (২১), শেরপুর (২২), রাজশাহী (২৩), জয়পুরহাট (২৪), গাইবান্ধা (২৫), লালমনিরহাট (২৬), হবিগঞ্জ (২৭), দিনাজপুর (২৮), সিলেট (২৯), চাঁদপুর (৩০), ফেনী (৩১), চট্টগ্রাম (৩২), বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি (৩৩), বাগেরহাট (৩৪), নড়াইল (৩৫), চুয়াডাঙ্গা (৩৬), যশোর (৩৭), ভোলা (৩৮), বরগুনা (৩৯) ও ঝালকাঠি (৪০), আজ জুমার জামাত : আজ শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ জুমার নামাজের জামাত। এ জামাতে শরিক হতে প্রতিবছরই রাজধানীর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে ভোর থেকেই আসতে থাকেন অসংখ্য মুসল্লি। ঢাকার কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা জোবায়ের এতে ইমামতি করবেন। তিন দিনের কর্মসূচি : বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে আম ও খাস বয়ান, দরসে কুরআন, দরসে হাদিস, তালিম, ছয়উছুলের হাকিকাত, চিল্লায় নাম লেখানো, পেশাভিত্তিক আলোচনা, যৌতুকহীন বিয়ে ও দেশ-বিদেশে নতুন জামাত তৈরি। প্রতিবন্ধী জামাত : এবারের বিশ্ব ইজতেমায় প্রায় তিন হাজার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, মূক ও বধির অংশ নিচ্ছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিবন্ধী মুসল্লিদের জন্য মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিকে রয়েছে বিশেষ নিবাস। এতে ১০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ওলামায়ে কেরাম নিয়োজিত থাকবেন। বয়ান : গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে ইজতেমার মূল কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ফজরে আম বয়ান পেশ করেন মাওলানা মোহাম্মদ হোসাইন, বাদ জোহর বয়ান করেন মাওলানা ওয়াসিমুল ইসলাম, বাদ আসর বয়ান করেন মাওলানা রবিউল হক এবং বাদ মাগরিব বয়ান করেন প্রবীণ মুরব্বি বুজুর্গ মাওলানা আহমদ লাট। বিভিন্ন দেশের মেহমানদের বয়ান বোঝার জন্য তাৎক্ষণিক মূল উর্দু ভাষার বয়ান বাংলা, ইংরেজি, আরবি, হিন্দি, তামিল, চীন, মালয়সহ ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে। কঠোর নিরাপত্তা : গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ জানান, ১০ হাজার পুলিশ ও তিন হাজার র‌্যাব ইজতেমার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা টহল থাকছে। ময়দানের চারপাশে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। তুরাগ নদে থাকছে নৌ-টহল এবং আকাশে থাকবে নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজরদারি। ট্রেনে বিশেষ সেবা : বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ইজতেমা উপলক্ষে ঢাকা থেকে ১৪টি ট্রেন টঙ্গী যাবে। ইজতেমার দিন টঙ্গী হয়ে চলাচলকারী সব ট্রেন কমপক্ষে দুই মিনিট দাঁড়াবে। আখেরি মোনাজাত শেষ হলে আন্তনগর ট্রেনগুলোর সময়সূচি এমনভাবে করা হবে, যাতে মুসল্লিদের যাতায়াতে সুবিধা হয়। সীমান্ত পেরিয়েই কষ্ট : চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আঞ্চলিক প্রতিনিধি আহসান হাবিব জানান, শিবগঞ্জ উপজেলার সোনামসজিদ বন্দর চেকপোস্ট দিয়ে ভারত থেকে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে আসা মুসল্লিরা পড়েছেন বিপাকে। সোনামসজিদ পুলিশ ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন বলেন, সোনামসজিদ চেকপোস্ট দিয়ে তিন দিনে ভারত থেকে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে বেশ কিছু ভারতীয় নাগরিক প্রবেশ করেছেন। চেকপোস্ট দিয়ে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে আসা ভারতের মালদা জেলার বহরমপুর এলাকার ফজলুল হক, রেকাতুল্লাহ মণ্ডল, আবু তাহের ও আবুল কালাম আজাদ জানান, তাঁদের স্থানে স্থানে কষ্ট করতে হচ্ছে। শীতের কারণে এ কষ্ট আরো বেশি। বেনাপোল প্রতিনিধি নুরুজ্জামান লিটন জানান, ভিসা জটিলতায় বিশ্ব ইজতেমায় যোগদান করতে আসা ৫০০ বিদেশি মুসল্লি আটকে পড়েছেন বেনাপোল চেকপোস্ট এলাকায়। গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এসব বিদেশি ইজতেমায় যোগ দিতে পারবেন না বুঝতে পেরে ইমিগ্রেশন অফিসের ভেতরই ওসিকে ঘিরে ফেলেন তাঁরা। এদিকে নাশকতার আশঙ্কায় এবার বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে পাকিস্তান, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ট্যুরিস্ট ভিসাধারী পাসপোর্ট যাত্রীদের আটকে দিয়েছে বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ। কলকাতা থেকে আসা ইসতিয়াক আহমেদ জানান, গত ১৬ বছর ধরে একই ভিসা নিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের ইজতেমায় যোগ দিয়ে আসছেন। দুবাই থেকে আসা তাবলিগ সদস্য ফয়সাল বলেন, 'আমি প্রতিবার বাংলাদেশে আসি একই ধরনের ভিসায়। এবার সরকার কেন বাধা দিচ্ছে, আমার জানা নেই। ' ইমিগ্রেশন পুলিশের ওসি আকতারুজ্জামান বলেন, শুধু তাবলিগ জামায়াতের ভিসা নিয়ে আসা মুসল্লিদের দেশে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু যাঁরা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে আসছেন, তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।      

No comments:

Post a Comment