গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৯ ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। তবে ইন্টারনেট ও ওয়াইম্যাক্স, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ডিশ সংযোগ রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সরকারের নির্দেশে শক্রবার গভীর রাতে বিদ্যুৎ এবং শনিবার সকালের দিকে পর্যায়ক্রমে মোবাইল, ইন্টারনেট, ওয়াইম্যাক্স এবং ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
p?n=acd94d5f' target='_blank'> শুক্রবার রাত ২টা ৩৭ মিনিটে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের (ডেসকো) একজন লাইনম্যান এ কার্যালয়ের বিদ্যুৎ কেটে দেয়। পরে শনিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ডেসকো বিদ্যুতের পুনঃসংযোগ দেয়। রাতের প্রথমভাগে বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়ার পর মুহূর্তেই এ কার্যালয়জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। দিনের আলোতে তেমন সমস্যা না হলেও সন্ধ্যায় অন্ধকার নামলে বিপত্তি দেখা দেয়। ওই সময় জেনারেটর বন্ধ থাকায় মোমবাতির আলোয় অন্ধকার তাড়ানোর চেষ্টা চলে। এরপর জেনারেটর চালু হয়। সর্বশেষ রাত ৯টা ৫০ মিনিটে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলে কার্যালয়ের সব আলো জ্বলে ওঠে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী নূর মোহাম্মদ রাতে যুগান্তরকে বলেন, গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন কে বা কারা কেটেছিল তা তিনি জানেন না। টেলিভিশনে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার খবরটি দেখেছেন। এরপর সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিলে তারা গিয়ে সংযোগ চালু করে এসেছে। ডেসকোর লাইনম্যান মোকছেদ আলী বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর উপস্থিত গণমাধ্যমকে জানান, গুলশান থানার নির্দেশে এসে লাইন কেটে দিয়েছি। এ বিষয়ে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে রাতে যখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হয় তখন গুলশান থানার এসআই সোহেল রানা উপস্থিত ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেসকোর এক কর্মকর্তা বলেন সরকারের নির্দেশেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। আবার সরকারের নির্দেশেই সংযোগ দেয়া হয়েছে। এর আগে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল বিকালে গুলশান কার্যালয়ে যুগান্তরের এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন। তিনি নিশ্চিত করেন, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ক্যাবল টিভির লাইন (ডিশ লাইন), ওয়াইম্যাক্স নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে হলে গুলশান ২ নম্বরে গিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে খবর পাওয়া গেছে, গ্যাস ও পানির লাইন কেটে দেয়ার জন্য ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক দলবল নিয়ে আসছেন। তার ধারণা রাতের মধ্যে পানির লাইন কেটে দেয়া হতে পারে। এতে ভোর রাতের পর থেকে পানির ট্যাংকে পানি না থাকার আশংকা ব্যক্ত করেন তিনি। মারুফ কামাল বলেন, বাড়িতে জেনারেটর চালানোর জন্য তারা দুই ড্রাম তেল কিনে এনেছিলেন। কিন্তু সরকারের আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ওই ড্রাম বাড়ির ভেতরে আনতে দেয়নি। তবে কিছু মোববাতি নেয়ার অনুমতি দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অফিসের সবাই চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। তিনি বলেন, তেলের অভাবে রাত ৮টা ১৩ মিনিটে জেনারেটরও বন্ধ হয়ে গেছে। পরে ৯টা ৪৫ মিনিটে আবার চালু হয়। জানা গেছে, সকালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, এয়ারটেল, টেলিটকসহ সব মোবাইল ফোন অপারেটর ও আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) অপারটেরদের কাছে লিখিত বার্তা পাঠায়। ওই চিঠিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়সংলগ্ন সব বিটিএস (ভয়েস ডাটা সেবা) টাওয়ার বন্ধ করে দিতে বলা হয়। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে জ্যামার বসিয়ে ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়ির সব নেটওয়ার্ক বন্ধ করার চেষ্টা চালায় সরকারের একটি সংস্থা। কিন্তু এতে ব্যর্থ হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসেবে বলা হয় জ্যামার বসানোর জন্য টাওয়ার লাগবে। এরপর প্রথম ৮৬ নম্বর সড়কসংলগ্ন গ্রামীণফোনের একটি টাওয়ারে জ্যামার বসিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। কিন্তু এতে ফল না আসায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিটিআরসির শরণাপন্ন হয়। এরপর বিটিআরসি বেলা ১১টার দিকে সব মোবাইল ফোন ও আইএসপি অপারেটরদের লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার সব বিটিএস বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। বিটিআরসির একটি সূত্র জানায়, সরকারের নির্দেশের পরপরই তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংকসহ ৫টি মোবাইল ফোন অপারেটরের ১০টি বিটিএস বন্ধ করে দেয়। তাদের ধারণা এতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়সহ আশপাশের অধিকাংশ বাড়ির নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ৫টি মোবাইল ফোন, ওয়াইম্যাক্স অপারেটর কিউবি, বাংলালায়ন ও ওলোর ফোরজি নেটওয়ার্কও কেটে দেয়া হয়। দুপুর ১টায় বিটিআরসির অপর একটি দল এসে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ক্যাবল টিভির ডিশ লাইন ও আইএসপি অপারেটরদের পরিচালিত ইন্টারনেটের ব্রডব্যান্ড লাইন কেটে দেয়। তবে বিটিআরসির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায় যেহেতু গুলশানের ওই এলাকাটি কূটনৈতিক পাড়া সেহেতু মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার কারণে যাতে কূটনীতিকদের কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য তাদের একটি বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। সূত্রটি দাবি করে তাদের উদ্যোগের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার সব দূতাবাস ও কূটনীতিকদের বাসভবনে টেলিফোন, ওয়াইম্যাক্স, ডিশসহ সব ধরনের নেটওয়ার্ক আছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, সকালের দিকে কিছুটা লাইন পাওয়া গেলেও বিকাল ৪টার পর থেকে পুরো কূটনৈতিক এলাকায় কোনো নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। বিকালের পর টিভি মিডিয়ার সংবাদ কর্মীরাও লাইভ কভারেজ করতে পরেননি। যথা সময়ে সংবাদ পাঠাতে পারেননি প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীরাও। একটি টেলিফোন অপারেটরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, সকাল থেকে পুরো কূটনৈতিক জোনে তাদের কোনো নেটওয়ার্ক নেই। এতে তারা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন। তিনি বলেন, এই এলাকার অধিকাংশ ফোন কল বৈদেশিক। এসব কলে বিলের পরিমাণও বেশি। সে কারণে লাভও বেশি। তিনি বলেন, এই অবস্থা যদি আরও ১ দিন চলে তবে তারা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা জানান, তিনি শুনেছেন, সংশ্লিষ্ট এলাকায় সব মোবাইল ফোনের অপারেটররা তাদের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু কিছু অপারেটরের ৫-৬টি করে বিটিএসও বন্ধ করে দিয়েছে বিটিআরসি। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিফোন নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশ (এমটব) সাধারণ সম্পাদক টিআইএম নুরুল কবিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। তবে তিনি জানান, বিটিআরসি নির্দেশনা অনুযায়ী অপারেটররা সাময়িকভাবে কিছু বিটিএস (টাওয়ার) বন্ধ করে দিয়েছে বলে তিনি শুনছেন। এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গুলশান ২ নম্বরের একটি বিশেষ ঠিকানায় মোবাইল (ভয়েস ও ডেটা) সেবা বন্ধ করার জন্য ৩১ জানুয়ারি শনিবার গ্রামীণফোন এবং অন্যান্য মোবাইল ও ওয়াইম্যাক্স অপারেটর বিটিআরসির কাছ থেকে একটি লিখিত নির্দেশনা পায়। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাঠানো ওই নির্দেশনা পরবর্তী নির্দেশনা দেয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকার কথা বলা হয়েছে। গ্রামীণফোনের ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ কারণে গুলশান ২ নম্বর এলাকার অনেক গ্রাহক সেবা পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন। সে জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মালয়েশিয়া থেকে স্বামী আরাফাত রহমান কোকোর লাশ নিয়ে আসা শর্মিলা রহমান দুই মেয়ে জাফিয়া ও জাহিয়াকে নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে ওই কার্যালয়ে রয়েছেন। দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, নিরাপত্তা সমন্বয়কারী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবদুল মজিদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানাসহ কয়েকজন বিএনপি নেতার পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ওই বাড়িতে আছেন। রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের ঘুম হয়নি বলে খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল জানিয়েছেন। ভোর ৫টার দিকে নিজস্ব জেনারেটর চালু করে ভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় বেলা ১টার দিকে প্রথম দফায় তা বন্ধ করা। পরে তেল কিনে এনে চালু করা হয়। গুলশানের ৮৬ নম্বর এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী আছিয়া খাতুন মৌ জানান, রোববার তার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তিনি সেটা তৈরি করতে পারেননি। এই অবস্থায় তিনি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন। মফিজ নামে অপর একজন বাসিন্দা জানান, তার দুই মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করছে। প্রতিরাতে তারা ইন্টারনেটে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন। বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। কিন্তু শনিবার রাত থেকে মেয়েদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সকালে গুলশান ২ নম্বরে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না। এ নিয়ে পুরো পরিবার চরম আতংকের মধ্যে আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকায় দায়িত্বরত আইনশৃংখলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, এই অবস্থার শিকার তারাও। শনিবার সকাল থেকে তারা পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। পরিবারের সদস্যরাও উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, শনিবার দুপুরে অনেকের পরিবারের সদস্যরা সরেজমিনে তাদের দেখে গেছেন গুলশানে এসে। অনেকে দায়িত্ব রেখে গুলশান ২ নম্বরের আশপাশে গিয়ে পরিবারের সদস্য এমনকি তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। শাহেদ নামে গুলশান এলাকার একজন বাসিন্দা জানান, তার এক ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। তার সবগুলো নোটস ল্যাপটপে বন্দি। ইন্টারনেটে পড়ালেখা করছে। এখন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তার ছেলের এসএসসি পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তিনি এখন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। স্থানীয়দের বক্তব্য ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তারা ভাইবার, ওয়াসঅ্যাপ, ট্যাংগো, লাইনসহ বিনামূল্যের অন্যান্য সেবাও নিতে পারছেন না। এতে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিদেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছেন না। একইভাবে হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনরাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
No comments:
Post a Comment