Sunday, February 1, 2015

অবরোধে লোকসানে পড়েছেন প্রান্তিক সবজিচাষিরা:নয়াদিগন্ত

টানা অবরোধে চরম লোকসানে পড়েছেন দেশের প্রান্তিক সবজিচাষিরা। যানবাহন সঙ্কটে দেশের বিভিন্ন বাজারে সবজি পাঠাতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক সবজির মূল্য না পেয়ে তে থেকে সবজি না তুলে নষ্ট করে দিচ্ছেন। আবার অনেকে কষ্ট করে হাটে আনলেও ক্রেতা না থাকায় পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও পাচ্ছেন না চাষিরা। প্রান্তিক এসব সবজিচাষিরা দাম না পেলেও রাজধানীতে চাহিদামতো সর
বরাহ না থাকায় সবজির দাম বাড়ছে। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের ।   বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন বলেন, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। সবজি বিক্রির উপযুক্ত সময় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। মাঠের ফসল বিক্রি করতে না পারলে কৃষক বোরোতে বিনিয়োগ করতে পারবেন না। এতে আমনের মতো বোরোতেও উৎপাদন কমতে পারে। ফলে দেশ খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল, তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।   গতকাল শনিবার রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা যায়, শিম বিক্রি হচ্ছে কেজি ৪০ টাকা দরে। কাঁচামরিচ ৫০ থেকে ৬০ টাকা। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা, টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। প্রতি কেজি শসা ৩০ টাকা। মুলা ১৫ টাকা, নতুন আলু ২০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা, করলা ৬০ টাকা। এ ছাড়া মাঝারি সাইজের প্রতিটি ফুলকপি ২০ থেকে ২৫ টাকা, বাঁধাকপি  ২০ থেকে ২৫ টাকা। লালশাক, কলমিশাক, লাউশাক, পালংশাক, মুলাশাক, পুঁইশাক, ডাটাশাকসহ নানা ধরনের শাকের আঁটি ৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।   একই সময়ে রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে শিম বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। কাঁচামরিচ ২৫ থেকে ৩০ টাকা। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা, টমেটো ২০ টাকা। প্রতি কেজি শসা ১৫ টাকা। মুলা ছয় টাকা, নতুন আলু ১০ টাকা, গাজর ১৫ টাকা, করলা ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি মাঝারি সাইজের ফুলকপি পাঁচ থেকে ১০ টাকা, বাঁধাকপি  পাঁচ থেকে ১০ টাকা।   রংপুর শহরে শিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ২০ টাকা। কাঁচামরিচ ৩০ থেকে ৪০ টাকা। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা, টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকা। প্রতি কেজি শসা ২০ টাকা। মুলা ছয় টাকা, নতুন আলু ১৫ থেকে ২০ টাকা, গাজর ১৫ টাকা, করলা ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি পিস মাঝারি সাইজের ফুলকপি ১০ টাকা, বাঁধাকপি  পাঁচ থেকে ১০ টাকা।   রাজধানীর ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীতের এ সময়ে সবজির ভরা মওসুম হলেও দাম কমছে না। দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কাঁচাপণ্যের সরবরাহ কমে গেছে। তা ছাড়া ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক চলাচল করায় ভাড়া বেড়েছে দুই থেকে তিন গুণ। পাশাপাশি সরবরাহ সঙ্কটে খুচরা বাজারে সবজির দাম বেড়েছে। অবরোধের প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন উৎপাদনকারী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এই অবস্থা চলতে সব পণ্যের দাম আরো বাড়বে।   রংপুর সংবাদদাতা সরকার মাজহারুল মান্নান জানান, অবরোধ ও দফায় দফায় হরতালে কয়েক শ’ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের। ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলে সবজি না যাওয়ার চার ভাগের এক ভাগ দামে চাষিরা বিক্রি করছেন সবজি। ফলে উৎপাদন খরচ তো দূরের কথা বাজারে আনার পরিবহন খরচই ঢুকছে না চাষির পকেটে। ২৫ দিনের অবরোধ ও হরতালে এই অঞ্চলে সবজিচাষি ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে ৪০৩ কোটি টাকার ওপরে।   নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার আবু মুছা নজুদ্দিন নামে এক কৃষক বলেন, বড় আশা করে আট বিঘা জমিতে আলু, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন সবজি লাগিয়েছিলাম। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ায় আশার গুঁড়েবালি। জমি থেকে বাজারে সবজি তুলে নিয়ে গিয়ে পানির দামে বিক্রি করতে হয়। বাইরের পাইকারেরা বাজারে আসেন না। স্থানীয় ক্রেতাদের চেয়ে বাজারগুলোয় আমদানি বেশি।   মিঠাপুকুর উপজেলার রানিপুকুর এলাকার সবজিচাষি ডালিম মিয়া বলেন, পাঁচ কেজি করে বাঁধাকপি বিক্রি করেছেন ২০ টাকায় আর ফুলকফি পাঁচ কেজি করে বিক্রি করেছেন ২৫ টাকায়।  প্রান্তিক এই চাষি ১০ বিঘা জমিতে সবজির আবাদ করেছেন। অবরোধ হরতালের কারণে সবজি আর বাজারে নিয়ে আসবেন না বলে জানালেন।   সদ্যপুষ্করিনী ইউনিয়নের জানকি ধাপেরহাট রামজীবন গ্রামের সবজিচাষি আবদুর রহমান দুই বিঘা জমিতে সিমের আবাদ করেছেন। গতকাল সিটিবাজারে পাঁচ কেজি করে লাল শিম ৭০ টাকা এবং সবুজ শিম পাঁচ কেজি করে বিক্রি করেছেন ৯০ টাকায়। গত বছর একই সময়ে এর দাম ছিল ২৭০ থেকে ২৯০ টাকা। অবরোধের কারণে সবজির দাম না থাকায় তিনি নিজের সাইকেলে করে সবজি এনেছিলেন বাজারে।   উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে জানা গেছে, টানা অবরোধ ও মাঝে মাঝে হরতালের কারণে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সবজি নিয়ে যেতে পারছে না ট্রাকচালকেরা। ফলে সবজি পচে যাচ্ছে। অন্য দিকে লোকসানের বোঝা দিনকে দিন ভারী হচ্ছে ক্ষুদ্র, মাঝারি সবজি ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক চাষিদের।   ট্রাক পরিবহন মালিক সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা থেকে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার ট্রাকে পল্লী এলাকা থেকে সবজি ব্যবসায়ীরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যেতেন। সেখানে প্রতি ট্রাকে প্রায় পঁচিশ থেকে পয়তাল্লিশ হাজার টাকার সবজি থাকত। টানা অবরোধের ২৫ দিন এসব রুটে ট্রাক চলাচল বন্ধ। পুলিশ বিজিবি পাহারায় যেসব ট্রাক যাচ্ছে তা নিয়মিত যাতায়াতের তুলনায় ১০ ভাগেরও কম। ফলে সবজি সরবরাহ প্রায় পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে করে প্রতিদিন প্রায় ১৫ কোটি টাকার সবজি বাইরে যাওয়া বন্ধ আছে। গত ২৫ দিনে প্রায় ৪০৩ কোটি ২০ লাখ টাকার সবজি বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে আছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের সবজি ব্যবসায়ী, প্রান্তিক কৃষকদের ওপর।   রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্র জানায়, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় দুই লাখ ৮৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে এবার শীতের শাকসবজির আবাদ হয়েছে; যা থেকে ৫০ লাখ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু উৎপাদিত সবজি অবরোধ ও হরতালের কারণে স্থানীয় ও বাইরের বাজারে নিয়ে না যেতে পারায় সবজিচাষি ও ব্যবসায়ীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।   কুষ্টিয়া সংবাদদাতা নুরুল কাদের জানান, অবরোধের ফলে কুষ্টিয়ার সবজি ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন। শীতকালীন সবজি যখন বাজারে ভরা মওসুম, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই দেশের অস্থিতিশীল অবস্থা।   তার পরেও অনেক সবজিচাষি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং বেশি ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে সবজি পাঠাচ্ছেন কিন্তু লাভের গুড়ের স্বাদ নিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।   প্রতিবারের মতো এবারো কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার শান্তিডাঙ্গা, বৃত্তিপাড়া, মৃত্তিকাপাড়া, রঞ্জিতপুর, ঝাউদিয়া, উজানগ্রাম, কুমারখালী উপজেলার বাঁশগ্রাম, পান্টি, মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া, নোয়াপাড়াসহ জেলার দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা শীতকালীন সবজি চাষ করেছেন। শীতকালীন আগাম সবজির বড় একটি অংশ কুষ্টিয়া অঞ্চলের সবজিচাষিরা করেন। এবারো তাই হয়েছে। তবে আগাম সবজি শেষের পর যখন মূল শীতকালীন সবজির বাজার শুরু হয়, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই অবরোধ কর্মসূচি শুরু।   অবরোধের প্রথম দিকে কুষ্টিয়া এবং আশপাশের এলাকার হাটবাজারে সবজির মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই ছিল। আবার অনেক এলাকার চাষি সবজি ঢাকা এবং অন্যান্য এলাকায় পাঠাতে না পারায় একেবারেই পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ দিকে এক মাসের মতো এই সময়ে শীতকালীন সবজির আবাদ কমে আসায় এখন আবারো সবজির দাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে বর্তমানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে ট্রাকে করে সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়ার বিভিন্ন হাটবাজারে সবজির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।   জেলার বৃত্তিপাড়া এলাকার কৃষক হাতেম শেখ জানান, আমরা প্রতি বছর সবজির আবাদ করে শীতকালে ভালো মুনাফা করি কিন্তু এবার মওসুম শুরুর মুহূর্ত থেকেই অবরোধের কারণে আমরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। তিনি জানান, বৃত্তিপাড়াবাজার থেকে প্রতি দিনই ঢাকার উদ্দেশে সবজির ট্রাক ছেড়ে যেত; কিন্তু অবরোধের কারণে এবার সবজি নিয়মিত পাঠানো সম্ভব হয়নি।    

No comments:

Post a Comment