যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই আন্দোলনের ছক চূড়ান্ত করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সে অনুযায়ী নীতিনির্ধারণী মহলসহ তৃণমূলে এই ছকের নকশা ইতিমধ্যে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সেই ছক অনুযায়ী চলছে আন্দোলন। যে কারণে শনিবার থেকে তিনি নীতিনির্ধারণী মহলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে না পারলেও পূর্বের নির্দেশনা অনুযায়ী চলমান আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এরই অ
ংশ হিসেবে এবার শুক্রবারও হরতাল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বুধবার ভোরে শেষ হচ্ছে ৭২ ঘণ্টার চলমান হরতাল। ওই দিন ভোর থেকে শুরু হয়ে শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত আবারও ৭২ ঘণ্টার (তিনদিন) হরতাল দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০ দলীয় জোট। আজকের মধ্যেই এ ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছে জোটের সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোট নেত্রী যদি গ্রেফতারও হন এবং তার সঙ্গে দলের কিংবা জোটের সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, সে ক্ষেত্রে আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বিভিন্ন ধাপে বিকল্প নেতৃত্ব দেয়ার রূপরেখা তৈরি করা হয়। গ্রেফতার হতে পারেন এমন বার্তা পাওয়ার পর গত শনিবার খালেদা জিয়া দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের এ বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়। এই রূপরেখা তৈরির আগে খালেদা জিয়া কথা বলেন জোটের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে। পরামর্শ নেন লন্ডনে অবস্থানরত ছেলে তারেক রহমানের। কোনো কারণে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হলে, কীভাবে কর্মসূচি চালিয়ে নেয়া হবে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দেয়া হয় তারেককে। আরও জানা গেছে, চলমান আন্দোলন থেকে কোনো কিছুতেই পিছু হটার লক্ষণ নেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের। যেকোনো পরিস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর তারা। গতি না কমিয়ে চলমান আন্দোলন কীভাবে আরও বেগবান ও শক্তিশালী করা যায় সে কৌশলে এগোচ্ছে। সহজেই আন্দোলন থেকে সরে আসছে না তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে। দুই দফা বিশ্ব ইজতেমার মধ্যেও তারা অবরোধ স্থগিত করেনি। এমনকি ছুটির দিনেও তা বহাল রাখে। সবশেষ এসএসসি পরীক্ষার মধ্যে হরতাল দেয়া হবে কিনা এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও রোববার থেকে ৭২ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণার মধ্য দিয়ে কঠোর অবস্থানের কথা জানান দেয়া হয়। সোমবারের এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে আগামী শুক্রবার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অনেকের ধারণা, শুক্রবার হরতাল দেয়া হবে না। কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে এবার শুক্রবারও হরতাল দেয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শনিবার থেকে গুলশান কার্যালয়ে ইন্টারনেট, ফ্যাক্স, টেলিফোনসহ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার আগ পর্যন্ত আন্দোলনের সার্বিক বিষয় সরাসরি মনিটর করতেন খালেদা জিয়া। অবরোধের পাশাপাশি কি করা যায় সে বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের পরামর্শও নিতেন তিনি। সূত্র জানায়, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দল ও জোটের নেতাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর বর্তমানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান আন্দোলনের সার্বিক বিষয় মনিটরিং করছেন। কর্মসূচি প্রণয়নসহ কিভাবে আন্দোলনকে আরও চাঙ্গা করা যায় তা নিয়ে নিয়মিত তৃণমূল নেতাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, ঘরে-বাইরে-ফুটপাতে কোথাও অবস্থান করা যাচ্ছে না। যেখানে যাকে পাচ্ছে তাকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। পাইকারি হারে গ্রেফতার করে আন্দোলনকে দমন করার ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, আন্দোলনের করণীয় নিয়ে দলের চেয়ারপারসন তাদের আগাম দিকনির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। তাকে গ্রেফতার করা হলেও আন্দোলন বন্ধ হবে না বরং নেতাকর্মীরা আরও বেশি চাঙ্গা হবেন। শুধু দলের চেয়ারপারসন নয়, লন্ডন থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। চূড়ান্ত সফলতা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন থামার কোনো আলামত নেই বলে দাবি করেন বিএনপির এই নেতা। সূত্র জানায়, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা না হলেও শনিবার থেকে তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। পরবর্তী করণীয় নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে নীতিনির্ধারকরা সহজেই যোগাযোগ করতে পারছেন না। গত কয়েকদিনে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশে কড়াকড়ি লক্ষ্য করা যায়নি। তবে গতকাল থেকে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। বাইরে থেকে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে নীতিনির্ধারকদের নেয়া সিদ্ধান্ত কারও মাধ্যমেও খালেদা জিয়াকে অবহতি করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার খালেদা জিয়ার বার্তা কাউকে বাইরে পাঠানো হচ্ছে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর নেতা মাহবুবুর রহমান শামীম যুগান্তরকে বলেন, কিভাবে আন্দোলনকে আরও গতিশীল করা যায় সে ব্যাপারে নানা দিকনির্দেশনাও ইতিমধ্যে তারা পেয়েছেন। দলের চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকে কয়েকদিন আগে টেলিফোনে তাদের বিস্তারিত জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়েছে। চেয়ারপারসনকে গ্রেফতার করা হলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কার্যালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি : রাজধানীর গুলশানের নিজ কার্যালয়েই এক মাস পার হল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। এ সময়ে কখনও পুলিশি বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ, কখনও বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে ছিলেন তিনি। শুক্রবার গভীররাতে কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ১৯ ঘণ্টা পর আবারও পুনঃস্থাপন করা হয়। তবে এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে ডিশ লাইন, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ। বন্ধ রয়েছে কয়েকটি মোবাইল নেটওয়ার্কও। দু’একটি মোবাইলের নেটওয়ার্ক সচল থাকলেও তা খুবই দুর্বল। ফলে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন খালেদা জিয়া। সোমবার পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছাড়া কোনোকিছুর সংযোগ দেয়া হয়নি। উল্টো কার্যালয় ঘিরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বেড়েছে। চাইলেও কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ কার্যালয়ের গেটের সামনে গেলেই গোয়েন্দারা তার পরিচয় জানতে চান। শুধু কার্যালয়ের নিয়মিত স্টাফ এবং খালেদা জিয়ার স্বজন ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এতদিন সাংবাদিক পরিচয় দিলে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিলেও গতকাল কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। এদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন গুলশান কার্যালয়ের ভেতর ঢোকার চেষ্টাকালে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আটককৃত ব্যক্তির নাম মাজহারুল ইসলাম। তিনি গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজের কাজ করেন বলে জানান। তার সঙ্গে একটি ব্যাগ ছিল। ব্যাগে একটি মোবাইল ফোন ছিল। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান জানান, কার্যালয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় আমরা সব ধরনের যোগাযোগ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। খবরাখবর আহরণে আমাদের একমাত্র মাধ্যম এখন পত্র-পত্রিকা। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়েন বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
No comments:
Post a Comment