Saturday, March 28, 2015

পুণ্যস্নানে এসে অশ্রুস্নান:কালের কন্ঠ

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী পুণ্যস্নানে গিয়ে হুড়োহুড়িতে পড়ে পদদলিত হয়ে মা, ছেলে, বউ, শাশুড়িসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৩০ জন। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় এক শিশুসহ কয়েকজনকে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় লাঙ্গলবন্দ বাজারে রাজঘাটসংলগ্ন একটি বেইলি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার গুজব রটলে হঠাৎ করে লোকজন হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে এ হতাহতের ঘটনা ঘট
ে। লাঙ্গলবন্দের পুণ্যস্নানের ইতিহাসে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এটিই প্রথম বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। নিহতদের পরিচয় : গতকাল পদদলিত হয়ে নিহতরা হলেন মানিকগঞ্জের জাদরা এলাকার বলাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৬০) ও তাঁর ছেলে নিতাই (নিত্য) গোপল দাস (৩০), গোপালগঞ্জ জেলার গোসালকান্দি গ্রামের নকুল চন্দ্র বিশ্বাস (৫৫), কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কালিপদ নন্দির ছেলে রঞ্জিত চন্দ্র নন্দি (৫৫), কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির নারায়ণ সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫০), কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের পরিমল সাহার স্ত্রী তুলসী দেবনাথ (৫২), ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতী দাস (৫০) ও তাঁর পুত্রবধূ রাখি দাস (২৮), নোয়াখালী জেলার কবিরহাটের অনিল চন্দ্র নাগের স্ত্রী ভানুমতি নাগ (৫০) এবং পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার মৃত বিজেন্দ্র লাল সাহার স্ত্রী সুচিত্রা রানী সাহা (৭০)। নিহতদের মধ্যে নকুল চন্দ্র বিশ্বাস মাদারীপুরের চরমুগরিয়া কলেজের অধ্যাপক। যেভাবে ঘটনা : স্নানোৎসবে আসা পুণ্যার্থী ও স্থানীয়রা জানায়, এবার শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় অনেকেই বৃহস্পতিবার রাতে এসেই বন্দরে স্নান উপলক্ষে তৈরি বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। সকাল থেকেই লোকজনের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড থেকে তিথি শুরু হওয়ার পরই ব্রহ্মপুত্র নদের ১৬টি ঘাটে স্নানে নামে লাখ লাখ হিন্দু পুণ্যার্থী। একটি সূত্র জানায়, এবার দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় ২০ লাখ পুণ্যার্থী এসেছে লাঙ্গলবন্দে। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার পানিতে অতিরিক্ত কচুরিপানা ও কাদামাটি থাকায় স্নান করতে আসা লোকজন বিড়ম্বনায় পড়ে। তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও পাপমুক্তির বাসনায় কচুরিপানা ও কাদামাটির মধ্যেই শেষ করে স্নান। পুণ্যস্নানের জন্য লাঙ্গলবন্দে যে ১৬টি ঘাট ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে রাজঘাটকে প্রধান বা বড় ঘাট হিসেবে ধরা হয়। এটি অনেক পুরনো ঘাট। এ ঘাটে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়েই স্নান শুরু হয়। তাই আগত পুণ্যার্থীদের মধ্যে এ ঘাটে স্নান করার ঝোঁক থাকে বেশি। আগতদের বিশ্বাস, ১৬টি ঘাটের মধ্যে রাজঘাটে স্নান করতে পারলে পাপ মোচন নিশ্চিত হয়ে থাকে। তাই এ ঘাটে পুণ্যার্থীদের ভিড়ও থাকে বেশি। গতকাল সকাল ৯টার দিকে রাজঘাটসংলগ্ন একটি বেইলি ব্রিজের ওপর হঠাৎ করে এক নারী পুণ্যার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে ব্রিজের এক পাশে তিনি বসে পড়েন। ওই সময় পেছন থেকে মানুষের স্রোতের সঙ্গে আসা কয়েকজন ধাক্কা খেয়ে ব্রিজের ওপর পড়ে গেলে 'ব্রিজ ভেঙে গেছে' বলে উচ্চ স্বরে গুজব ছড়িয়ে দেয় উপস্থিত ৮-১০ জন অজ্ঞাতপরিচয় যুবক। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন হুড়োহুড়ি করে ছুটতে থাকে। রাজঘাটসংলগ্ন তিন রাস্তার মোড়ে ওই সময় ভিড়ের চাপে পদদলিত হতে থাকে একের পর এক পুণ্যার্থী। তাদের মধ্যে ১০ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পদপিষ্ট হয়ে আহত হয় কমপক্ষে ৩০ জন। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন ও লাঙ্গলবন্দ স্নান উদ্‌যাপন পরিষদের সেক্রেটারি বাসুদেব চক্রবর্তী ১০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসবের সেক্রেটারি বাসুদেব চক্রবর্তী জানান, নিহতদের পরিবারের লোকজনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনারা নাজমীন জানান, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। এ সময় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ইউএনও বলেন, এটি স্রেফ একটি দুর্ঘটনা। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি ছিল গুজব। বন্ধের দিন হওয়ায় ওই স্নানঘাটে পুণ্যার্থীদের ঢল নেমেছিল। ভিড় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় পদদলিত হয়ে হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়। গত বছর রাস্তাটি ছিল ১২ ফুট প্রশস্ত। এবার ১৬ ফুট করা হয়েছে। এ বিষয়ে লাঙ্গলবন্দ স্নানোৎসব কন্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রক নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, অতিরিক্ত ভিড়ের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। অতীতে লগ্ন থাকত ৪৮ ঘণ্টা। এবার ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। অল্প সময় থাকায় এবার একসঙ্গে অনেক পুণ্যার্থী ঢুকে পড়ে। শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড থেকে তিথি শুরু হতেই হাজার হাজার পুণ্যার্থীর ঢল নামে। লাঙ্গলবন্দ স্নান এলাকায় একটি বেইলি ব্রিজ আছে। ওই ব্রিজ ব্যবহার করে স্নানঘাটগুলোতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পার হচ্ছিল হাজার হাজার পুণ্যার্র্থী। ওই ব্রিজটি ছিল সরু। ব্রিজটি পার হওয়ার পর রাস্তা ছিল আরো সরু। ওই সরু রাস্তায় ওঠার পর পুণ্যার্থীদের হুড়োহুড়িতে পদদলিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো জানান, এ ছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই এ ঘটনার পেছনে। নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. দুলাল চন্দ্র চৌধুরী জানান, চারটি অ্যাম্বুল্যান্সের মাধ্যমে নিহতদের লাশ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আহত কাউকে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। লাঙ্গলবন্দে তিনটি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, 'ঘটনাটি মর্মান্তিক। এ ঘটনার জন্য লাঙ্গলবন্দের অবৈধ দখলদারদের দায়ী করছি আমি। তারা অবৈধভাবে দোকানপাট তৈরি করে মানুষের যাতায়াতের রাস্তা সরু করে ফেলেছে, যার ফলে এমন ঘটনা ঘটেছে। আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, যাঁরা অবৈধ দখলদার আছেন তাঁরা যেন এখনই জায়গাগুলো ছেড়ে দেন।' নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, 'শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিন থাকায় এবার পুণ্যার্থীর আগমন প্রচুর হয়েছে। বেইলি ব্রিজের আগের রাস্তাগুলো বেশ প্রশস্ত কিন্তু বেইলি ব্রিজে এসে রাস্তাটি হঠাৎ সরু হয়ে যাওয়ায় সেখানে পুণ্যার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় জমে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে আমার মনে হচ্ছে।' তিনি আরো বলেন, দ্রুত বেইলি ব্রিজ এবং এর আশপাশের সড়কগুলো আরো প্রশস্ত করার ব্যবস্থা করা হবে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি : অষ্টমী স্নানোৎসবে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এ কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এ কমিটি গঠন করা হয় বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা। তিনি জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক ইশরাত হোসেনকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুর রহমান হাবিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মিজানুর রহমান। 'ভগবান, তুমি একি করলে...' : স্বামী নিত্য গোপালের সঙ্গে শাশুড়ি, মেয়ে ও প্রতিবেশীদের নিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি দল পাপ মোচনের বিশ্বাস নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলার জাবরা এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে এসেছিলেন রূপালী দাস। কিন্তু পুণ্যস্নানে এসে শাশুড়ি ও স্বামীকে হারিয়ে এখন নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছেন তিনি। স্বামী ও শাশুড়িকে হারিয়ে যখন নির্বাক রূপালী দাস তখন তাঁর মেয়ে পূজা হাসপাতালে ভর্তি। পূজা জানেও না তার বাবা ও ঠাকুরমা ইতিমধ্যে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। লাঙ্গলবন্দ আওয়ামী লীগ অফিসে সেলিম ওসমানের দেওয়া অনুদানের টাকা দেওয়ার জন্য যখন নিত্য গোপাল ও মালতি রানীর নাম ঘোষণা করা হয়, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন রূপালী দাস। আর্তনাদ করে বলেন, 'ভগবান তুমি একি করলে? আমার সব নিয়ে গেলে! আমি এখন কী করে বাঁচবো?' সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর দেড়টায় নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। নিহত বানু মতির স্বামী অনিল চন্দ্র বুক চাপড়ে কাঁদছেন আর বলছেন, 'ওর সাথে আমাকে কেন নিয়ে গেলে না ভগবান?' নিহত কানন সাহার স্বামী অরুন চন্দ্র বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলেন লাশের পাশেই। বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, পুণ্যার্থীরা স্নান করছে অশ্রুসিক্ত নয়নে। কুমিল্লা থেকে আসা পুণ্যার্থী নিরবালা রায় বলেন, 'ভাবতে পারিনি এমন একটি ঘটনা ঘটবে। এ ঘটনায় আমাদের পুণ্যস্নান পরিণত হয়েছে অশ্রুস্নানে।' ঘটনার পরপরই স্নান এলাকায় পূর্বনির্ধারিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করে সেখানে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় গীতা পাঠের আয়োজন করে স্নানোৎসব কমিটি। রাষ্ট্রপতির শোক : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ লাঙ্গলবন্দে পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু ও অনেকের আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক প্রকশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর শোক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল এক শোকবার্তায় নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার শোক : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। তিনি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়িত্বে অবহেলাকারী এবং দোষীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানান। ময়মনসিংহে ডুবে স্কুলছাত্রের মৃত্যু : অষ্টমী স্নান করতে গিয়ে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদে ডুবে মারা গেছে এক স্কুলছাত্র। তার নাম অন্তর দাস (১৪)। গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। সে ময়মনসিংহ শহরের নওমহল এলাকার রঞ্জন চন্দ্র দাসের ছেলে। অন্তর স্থানীয় মুকুল নিকেতন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পরিবার সূত্রে জানা যায়, লোকজনের সঙ্গে নদে স্নান করতে নেমে আর উঠে আসেনি অন্তর। লোকজন খবর দিলে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে অন্তরকে উদ্ধার করে। পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নদের গর্তে পড়ে এমন মৃত্যু হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবুল হোসেন জানান।    

No comments:

Post a Comment