নিজের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন তিনি। সেই রায়ে পঞ্চম সংশোধনীর সব কিছু অবৈধ ঘোষণা করলেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা ও জনস্বার্থে যে কয়েকটি বিষয় তিনি রায়ে বহাল রেখেছিলেন তার অন্যতম ছিল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। কিন্তু সেই একই বিচারপতি এখন সু
প্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করে বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদকে দিয়ে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগের পে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করলেন। তিনি বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে রয়েছে। এতে ভয়ের কিছু নেই। ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। ওই রায়ে বলা হয়, সামরিক আইন সামগ্রিকভাবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক এবং সামরিক আইনের অধীনে করা সব কার্যক্রম, আইন এবং বিধিও অবৈধ। রায়ে পুরো পঞ্চম সংশোধনীর একটিমাত্র সামরিক ফরমানের পরিবর্তনকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে ঝবপড়হফ চৎড়পষধসধঃরড়হ ঙৎফবৎ ঘড়. ওঠ ড়ভ ১৯৭৬। এই প্রকেমেশনে চতুর্থ সংশোধনীর একটি বিধান বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুরূপ একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের মতা দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের প্রকেমেশনে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শক্রমে অন্যান্য বিচারক নিয়োগ করতে হবে। একই সাথে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকেও বহাল রাখা হয় এতে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। তার নেতৃত্বাধীন কমিশনে সদস্য হিসেবে আছেন সেই দ্বৈত বেঞ্চের দ্বিতীয়জন। তারাই গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিচারকদের অভিশংসনের মতা সংসদকে দিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ুণœ হবে না। গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডে এই ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত গণতন্ত্রের সব দেশেই এটা আছে। ভারতেও এটা আছে। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের অবস্থা উন্নত দেশগুলোর মতো না হওয়ার পরও বিচারক অভিশংসনের মতা সংসদকে দেয়া ঠিক হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংসদকে এই মতা দেয়ার সময় ওই সব দেশের অবস্থাও আমাদের মতোই ছিল। ৫ জানুয়ারির মতো ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের কাছে এ ক্ষমতা দেয়াটা কতটা যৌক্তিকÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইলেকশন কমিশন বলেছে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনেও ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে কি না সন্দেহ। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে নির্বাচন হয়েছে, তা যেকোনো নির্বাচনের চেয়েই ভুয়া। এই মতা সংসদকে ফিরিয়ে দিলে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে মন্তব্য করে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশে বাহাত্তরের সংবিধানেও এটা ছিল। কিন্তু কাউকে অভিশংসন করা হয়নি। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বা যেকোনো প্রতিষ্ঠান জনগণের প্রতিষ্ঠান। সব প্রতিষ্ঠানই জনগণের পয়সায় চলে। তাই সবারই জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই আমরা আমাদের (আইন কমিশন) সুপারিশে বলেছিলামÑ কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারক যদি কোনো অসদাচরণ করে থাকেন, তাহলে প্রয়োজনে এ বিষয়ে মূল সংবিধানে যে বিধান করা আছে তা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। কারণ, পার্লামেন্ট আমাদের সার্বভৌম জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে। এর আগে ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি দেশের প্রধান বিচারপতি থাকাকালে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগÑ আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। কেউ কারো ওপরে নয়। এ দিন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বিচার বিভাগ কারো ওপরে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছে না। তাই আমরা অন্য কাউকে বিচার বিভাগের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে দেবো না। কারো বলা উচিত নয় যে তারা শ্রেষ্ঠ এবং তাদের কাছে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গের ওপরে এর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছে না। তাই বিচার বিভাগের ওপর অন্য অঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা উচিত নয়। আমরা একে অপরের পরিপূরক। শ্রেষ্ঠত্ব বা সার্বভৌমত্বের মালিক বাংলাদেশের জনগণ। অন্য কেউ নয়। আমরা বাংলাদেশের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, সংসদের ক্ষমতা জনগণের ক্ষমতা থেকে উৎসারিত। নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাও জনগণের ক্ষমতা থেকে থেকে পাওয়া। চাঁদ যেমন সূর্যের আলোয় আলোকিত, তেমনি বিচার বিভাগের ক্ষমতা জনগণ থেকে উৎসারিত। তিনি বলেন, কারো বলা উচিত নয়, আমরা শ্রেষ্ঠ এবং তাদের কাছে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিচার বিভাগের নিজেদের মতো জবাবদিহি রয়েছে। বিচার বিভাগের জবাবদিহি প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা অন্যদের জবাবদিহির মতো নয়। জবাবদিহি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে আলাদা হয়। কবির জবাবদিহি তার পাঠকের কাছে। বিচারকের জবাবদিহি রায়ের যুক্তির মধ্যে। আমরা সৃষ্টিকর্তা ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। তবে ভিন্নভাবে। এ দিকে বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে থাকলেও পরে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে তা রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া হয়। পরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দেন। বিচারপতি খায়রুল হক এর আগেও স্ববিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। নিজের দেয়া রায় লঙ্ঘন করে যোগ দিয়েছেন রাষ্ট্রের ‘লাভজনক পদ’ আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে। ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ে তিনি ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে’ এ জাতীয় পদে বিচারপতিদের সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয় বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু অবসরের দুই বছরের মাথায় তিনি নিজেই যোগ দিলেন এমন একটি লাভজনক পদে। তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে বিবেচনায় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচারপতিদের নিয়োগ অনাকাক্সিত বলে মনে করেন, সেই একই বিবেচনায় তার কর্তৃক একটি লাভজনক নিয়োগ গ্রহণও অনাকাক্সিত। গত ২৩ জুলাই আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিন বছরের জন্য তিনি এ নিয়োগ পান। এ বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা আদেশে আরো বলা হয়, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে খায়রুল হক বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির প্রাপ্য বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধাদি পাবেন। উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের অবসর গ্রহণের পর আবার সরকারি চাকরিতে তার নিয়োগকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। গণপরিষদ বিতর্কে চাকরিকালীন বিচারকদের নিরপেতা রার জন্য এটি প্রয়োজন বলে অভিমত দেয়া হয়। আবদুল বারী শিকদার বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পর্যবেণে বলা হয় যে, যদি অবসরের পর বিচারকদের সরকারি কোনো পদে নিয়োগের বিধান থাকে, তাহলে বিচারকরা ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের দিকে চোখ রেখে কর্তৃপগুলোর পে রায় দিতে প্রভাবিত হতে পারেন (২০০৫ সালে মানবজমিন বনাম বাংলাদেশ মামলায় অনুরূপ পর্যবেণ করা হয়)। কিন্তু ১৯৭৭ সালের এক সামরিক ফরমানবলে বিচারকদের অবসর-পরবর্তী সময়ে বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদে সরকারি চাকরিতে (প্রজাতন্ত্রের কর্মে) নিয়োগদানের বিধান করা হয়। ১৯৯৬ সালে বিচারকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগদানের বিধানও করা হয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে বিচারপতিদের নিয়োগ রাজনৈতিক সমঝোতাপ্রসূত একটি বিষয় ছিল এবং এই পদটি প্রচলিত অর্থে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত পদের মতো নয়। তবু বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় এই পদে বিচারকদের অবসর-পরবর্তী সময়ে নিয়োগ উচ্চ আদালতের নিরপেতার জন্য হুমকিস্বরূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তারই নির্দেশক্রমে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে বিচারকদের অবসর গ্রহণ করার পর প্রজাতন্ত্রের সব ধরনের কর্মে নিয়োগকে অবৈধ করা হয়, যদিও এ-সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট উল্লেখ তার রায়ে ছিল না। এ বিষয়ে সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী-অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন ব্যতীত) বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোন আদালত বা কোন কর্তৃপরে নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’ বিচারপতি খায়রুল হক সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেছেন, আজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিরতা তার জন্য একমাত্র দায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে রায় না দিতেন তাহলে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার বদল হতো। কিন্তু পার্লামেন্টে সমাধানকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক বিশেষ উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের ইচ্ছানুযায়ী এই রায় দিয়েছেন বলে অনেকের ধারণা। তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে সরকারের কাছ থেকে অনুদানের অর্থ গ্রহণ করেছেন। আবার প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নিয়ে একই মর্যাদায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এসব থেকে মনে হয়, তিনি বিশেষ সুবিধা ভোগের উদ্দেশ্যে জাতিকে একটি সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment