সরকার এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের লক্ষ্যে এই সময়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন করার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। সরকারি দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে এ কথা জানা গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এই ভোটের মধ্য দিয়ে একদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলনকে রাজধানী ঢাকায় আরও অকার্যকর করে ফেলা যাবে; অন্যদিকে বিএনপির নাজুক সাংগঠনিক পরিস্থিতির কারণে যে পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে
, তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সহজে জিততে পারবেন। আর এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দল যে এখনো জনপ্রিয়, তা দেখানোর সুযোগ পাবে। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ গতকাল বৃহস্পতিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে প্রাক্নির্বাচনী বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কমিশন জুনের আগেই ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচন করার চেষ্টা করবে। তবে কমিশন সূত্র জানিয়েছে, কমিশন সচিবালয় এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের ভোট গ্রহণের দিন ধার্যের প্রস্তাব করেছে। এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেওয়ার নানা তোড়জোড় করেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে সরকার সরে আসে বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তবে তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি চলছে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যেই গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত ঢাকা সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে নির্দেশ দেন। সরকারি দলের উচ্চ পর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, বিরোধী জোটের চলমান কর্মসূচিকে আরও নিস্তেজ করে দেওয়ার লক্ষ্যে এ সময়ে সরকার এই নির্বাচনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত এতে অংশ নেবে না ধরে নিয়েই সরকারি দল এ বিষয়ে ছক কষছে। আর কোনো কারণে বিএনপি নির্বাচনে এলেও নাজুক সাংগঠনিক অবস্থা এবং নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা ও ধরপাকড়ের কারণে তারা সুবিধা করতে পারবে না। আবার এ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে উভয় সিটি করপোরেশনেই আওয়ামী লীগ নিজ দলেরই একাধিক প্রার্থী দাঁড় করানো ছাড়াও জাতীয় সংসদে অনুগত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকেও প্রার্থী দিতে উৎসাহ দেবে দলে দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার নির্বাচন নিয়ে সরকার একটা ঝুঁকি নিয়েছে। এতে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভোটার উপস্থিতি দেখাতে পারলে আন্তর্জাতিক মহলে এই বার্তা দেওয়া যাবে যে সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। আবার ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মতো ভোটার টানতে না পারলে রাজনৈতিক পরাজয় হবে। এরই মধ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক ও সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকনকে গণভবনে ডেকে নিয়ে দুজনকে যথাক্রমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সমর্থনের কথা জানান। দুজনেই গণভবন থেকে বেরিয়ে তা গণমাধ্যমকে জানান। দুজন এরই মধ্যে জনসংযোগ শুরু করেছেন। অরাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েও সরকারি দলের প্রার্থী হয়ে তাদের রাজনৈতিক কৌশলের ঘুঁটি হলেন কি না, জানতে চাইলে আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, একেকজন একেকভাবে ভাববে। প্রত্যেকের ভাবনার কিছু সারমর্ম আছে। তিনি তাঁর বাবা ও ছোট মেয়ের দেওয়া পরামর্শের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তারা বলেছে, তুমি নিরপেক্ষ পারসোনালিটি নিয়ে বসে থাকতে পারো। আবার সমাজের জন্য কিছু করতেও পারো। পাঁচ-সাত বছর পর হয়তো বয়সের কারণে সেটা পারবে না। এর পরই আমি সুযোগটা নিয়েছি।’ আর সাঈদ খোকন বলেছেন, বিরোধী দলের আন্দোলনের কোনো প্রভাব ঢাকায় নেই। তাঁর প্রত্যাশা, নির্বাচন সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। এ দুজনের বাইরে ঢাকা দক্ষিণে ঢাকা-৭ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ সেলিম নিজেকে মেয়র পদপ্রার্থী ঘোষণা করে প্রচার শুরু করেছেন। ব্যানার-বিলবোর্ডে দক্ষিণে প্রার্থী হওয়ার কথা জানান দিচ্ছেন মিরপুরের সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদারও। সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থী জানান, অনেকেই প্রধানমন্ত্রীসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে দলীয় সমর্থন চান। দলীয় সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে কৌশল কাজ করেছে। তবে দলের যে কেউ প্রার্থী হলে বাধা দেওয়া হবে না। আগে কেন নির্বাচন হয়নি ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০০২ সালে। সে সময় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মেয়াদ শেষ হলেও নির্বাচন হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে তিনবার নির্বাচন করার আওয়াজ তুললেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এর মধ্যে ঢাকা সিটি নির্বাচনের বিষয়টি প্রথম জোরেশোরে আলোচনায় আসে ২০১০ সালে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার মতে, বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা সিটি নির্বাচন দেওয়ার মোক্ষম সময় ছিল। তখন অবিভক্ত সিটি নির্বাচনে সাবের হোসেন চৌধুরীকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনে করা হতো। কিন্তু এক-এগারোর সময়ে কথিত ‘সংস্কারপন্থী’ তকমা জুড়ে দেওয়ার কারণে তাঁকে দলীয় প্রার্থী করতে আগ্রহী ছিলেন না শীর্ষ নেতৃত্ব। বিকল্প ভালো প্রার্থী খুঁজে না পাওয়ায় এবং বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যার কারণে নগরবাসী বিরক্ত থাকায় তখন আর নির্বাচন দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাননি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তা ছাড়া ২০১০-এর জুনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভরাডুবি হয়। অবশ্য তখন নির্বাচন না দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারণ হয়নি অভিযোগ তুলে উচ্চ আদালতে করা এক রিট আবেদনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ নেই বিএনপির ওই সময় বিরোধী দলের নেতাকে রাজধানীতে মেয়র পদে রাখায় সমালোচনা শুরু হয় আওয়ামী লীগের ভেতরে। এরপর ২০১১ সালের নভেম্বরে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১২ সালের এপ্রিলে দুই সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তাতে ২৪ মে ভোট গ্রহণের কথা ছিল। তখন প্রায় দুই ডজন প্রার্থী মেয়র পদে এবং কয়েক শ কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র ক্রয় করেছিলেন। আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, তখন একাধিক সংস্থাকে দিয়ে জরিপ করে দেখা যায় যে নির্বাচনে সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা কম। ফলে আবারও নির্বাচন নিয়ে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে সরকার। ওই অবস্থায় ভোটার তালিকা হালনাগাদ হয়নি এবং সীমানা নিয়ে জটিলতা রয়েছে বলে একটি বেসরকারি সংগঠন হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত করে রুল জারি করেন। পরে ২০১৩ সালে আদালত ওই রিট খারিজ করে আদেশ দেন। এরপর ওই বছরের জুলাইয়ে ভোট গ্রহণের লক্ষ্যে আবার তোড়জোড় শুরু করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তার আগে একই বছরের জুনে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়। চারটিতেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। জুলাইয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সরকারি দল সর্বশক্তি নিয়োগ করেও দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে পারেনি। এসব ফলাফল দেখে ক্ষমতাসীন দল আবার ঢাকা সিটি নির্বাচনের চিন্তা থেকে সরে আসে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্ত্রী জানিয়েছেন। অবশ্য নির্বাচন থেকে সরে আসার অজুহাত হিসেবে তখন নির্বাচন কমিশন বলেছিল, হাজারীবাগের সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কিন্তু এটি কোন ওয়ার্ডের অধীনে হবে, তা ঠিক করেনি। তাই সুলতানগঞ্জকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের পরামর্শ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ধারণা ছিল, এভাবে নির্বাচনে গেলে আবারও মামলা-মোকদ্দমায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এক বছর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত ছিল। এ সময় সরকার পাঁচ পর্বে ভাগ করে সারা দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দেয়। প্রথম কয়েক পর্বে সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের তুলনায় বিএনপি ও জামায়াত-সমর্থিতরা বেশিসংখ্যক উপজেলায় জয়ী হন। শেষের দিকে সরকার-সমর্থক প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ ওঠে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব অজুহাতে আট বছর নির্বাচন হয়নি, তা থেকে বোঝাই যাচ্ছিল, সরকারের আগ্রহ ছিল না। এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার অর্থই হচ্ছে মনোযোগ ভিন্ন খাতে নেওয়া। তিনি বলেন, বিএনপিসহ বিরোধীরা না এলে নির্বাচনটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কি না, সে সন্দেহ রয়েছে।
No comments:
Post a Comment