পতাকাটা দুলে উঠলেই দুলে ওঠে মন। এক অনিবার সাহস এসে ভর করে শরীরে। লাল-সবুজের দোলায়মান ছন্দে যেন বাংলার মানুষ খুঁজে পায় নিজেকে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বাংলাদেশের অন্যতম প্রতীক। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দেশের মানুষ সচেতন হলো একাত্তরের ২ মার্চের পর। ১ মার্চ যখন ইথারে ভেসে এল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ, যখন তিনি স্থগিত করলেন ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন, তখনই বারুদে আগুন লাগল। সারা বাংলাদেশ যেন
সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে এল ‘মানি না, মানি না’ উচ্চারণে। মিছিলে মিছিলে রচিত হতে লাগল একটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের ইতিহাস। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা তখন শেখ মুজিবুর রহমান। সত্তরের নির্বাচনে তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্র ও প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে। পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বললে শেখ মুজিবুর রহমানকেই বোঝায়। কিন্তু ইয়াহিয়া আর জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতার হাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনভার তুলে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন। আর সেই উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই এক এক করে বিদায় নিচ্ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের চিহ্নগুলো, আর সেখানে এক এক করে ফুটে উঠছিল বাংলাদেশের প্রতীক। আমাদের পতাকাটিও সেই পথেই ইতিহাসের তীরে নৌকা ভেড়াল। কাপড়ের পতাকায় ফুটে ওঠল রাষ্ট্রসত্তা। কীভাবে জন্ম হয়েছিল এই পতাকার? মহিউদ্দিন আহমদের এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল বইটিতে এই পতাকার জন্মকথার বয়ান আছে এভাবে, ‘ছয়ই জুন রাতে (১৯৭০ সাল) আমি ইকবাল হলে যাই। ১১৮ নম্বর কক্ষে ঢুকতেই দেখি একজন এক টুকরো কাপড়ে কী একটা আঁকছেন। দেখলাম বটলগ্রিন (গাঢ় সবুজ) জমিনের মধ্যে একটা লাল সূর্য, সূর্যের মধ্যে সোনালী রং দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকছেন শিবনারায়ণ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিস ছিল বলাকা বিল্ডিংয়ের তিন তলার এক কোণে। পাশে ‘নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স’ নামে একটি দর্জির দোকান। দোকানের মালিক এবং কর্মচারীরা সবাই বিহারি। মানচিত্র আঁকার পর বটলগ্রিন ও লাল কাপড়ের টুকরো দুটো এই দোকানেই সেলাই হয়। মানচিত্র সংযোজনের প্রস্তাব দেন সিরাজুল আলম খান, যাতে কেউ ‘‘যুক্ত বাংলা” বানানোর স্ক্যান্ডাল ছড়াতে না পারে।’ (এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল, পৃষ্ঠা ৪৫)। ৫ ও ৬ জুন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়েছিল মতিঝিলের হোটেল ইডেনে। ৭ জুন সকালে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্যারেড হয়েছিল। ওই প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর পাশে ছিলেন ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজ। প্যারেডে নেতৃত্ব দেন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব। তাঁর হাতেই ছিল বাঁশের লাঠিতে বাঁধা পতাকাটি। রব এই পতাকা হস্তান্তর করেন বঙ্গবন্ধুর হাতে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বটতলায় আয়োজিত সমাবেশে সেই পতাকাটিই তুলে ধরেন আ স ম আবদুর রব। আফসান চৌধুরীর বাংলােদশ ১৯৭১ বইতে বলা হয়েছে, ‘...২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ছাত্র নেতৃবৃন্দের পতাকা উত্তোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশে ডাকসু সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব সবুজ পটভূমির ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালী মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ডাকসু ও ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী। এ ছাড়া ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন। এখানে আরো উপস্থিত ছিলেন পূর্বতন ছাত্রনেতা এবং আওয়ামী লীগের এমএনএ তোফায়েল আহমেদ।’ (বাংলাদেশ ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫২) একই দিনের ঘটনা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বর্ণনায় এ রকম, ‘২ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের ছাত্রসভায় প্রথম স্বাধীন বাংলার যে পতাকা উত্তোলিত হয়, তার মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ছিল। বাঙালি তরুণেরা স্লোগান দিয়েছিলেন, “হয় ছয় দফা, নয় এক দফা।” খুব দ্রুত সেই স্লোগানের রূপান্তর ঘটে-“ছয় দফা নয়, এক দফা এক দফা”। “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”—সেই অভিনব রাজনৈতিক আহ্বানে বাঙালি অভূতপূর্ব উত্সাহ ও উন্মাদনায় সাড়া দিয়েছিল। (‘বাঙালির রাষ্ট্র-সাধনা’, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথম আলো, ২৬-০৩-২০১০)। ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে তাঁর বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে এই পতাকাই প্রেরণা জুগিয়েছিল বঙ্গবাসীর মনে। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশের করা পতাকাটির লাল বৃত্তের মাঝে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পতাকাটি দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। মুক্তির গান চলচ্চিত্রেও শিল্পীদের হাতে দেখা গেছে এই পতাকা। পরে ১৯৭২ সালে শিল্পী কামরুল হাসানকে পতাকার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তিনি শিবনারায়ণ দাশের আঁকা মানচিত্র-সংবলিত পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দিয়ে যে পতাকাটির ডিজাইন করেন, সেটিই এখন আমাদের জাতীয় পতাকা। এরপর তুলে দেওয়া যাক সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হকের কথা। এই সাংবাদিক ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা জানাচ্ছেন। লিখছেন, ‘২রা এপ্রিল কামাল সিদ্দিকী, কাজী ইকবাল এবং আবুল খায়ের লিটুকে নিয়ে গাড়িতে করে আমরা রওয়ানা হই। পথে সাভার থেকে আমরা হাসান ইমামকে তুলে নিই।...আরিচা দিয়ে আমরা নৌকা পথে ঝিনাইদহ যাই এবং আশ্চর্য্য হলেও লক্ষ্য করি যে নদীর ওপারে ‘জয় বাংলার’ পতাকা উড়ছে। সেখানে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২)। মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামটিতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পরও এই ঘোষণাপত্র সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন দেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, তখন সংবিধান হিসেবে এর কার্যকারিতার সমাপ্তি ঘটে। সেই অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিও পরিবেশন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের সাময়িক শাসনতন্ত্র অধ্যাদেশ জারি করেন, সেদিনই তিনি রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১২ জানুয়ারি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয়, তার মধ্যে একটি ছিল জাতীয় পতাকাবিষয়ক। বলা হয়, জাতীয় পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে না, লাল সূর্য থাকবে। জাতীয় পতাকার এই রূপটি গৃহীত হয় ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭২। জাতীয় পতাকার কথা বলতে গেলে আমাদের জাতীয় সংগীত রচয়িতার অসাধারণ পঙ্ক্তিটিই মনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’।
No comments:
Post a Comment