Tuesday, March 10, 2015

আনন্দে ভাসছে বাংলাদেশ:যুগান্তর

রুবেল হোসেনের আগুনে গোলা অ্যান্ডারসনের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে স্টাম্পে চুমু খেতেই গ্যালারিতে লাল-সবুজের মহাবিস্ফোরণ! আবেগ, উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসার সেই সর্বগ্রাসী ঢেউ অ্যাডিলেডের গ্যালারি থেকে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে। আবেগে থরথর মাশরাফি চুমু এঁকে দিলেন অ্যাডিলেড ওভালের সবুজ ক্যানভাসে। স্বপ্ন হল সত্যি, চট্টগ্রাম ফিরে এলো অ্যাডিলেডে! চার বছর আগে চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই উইকে
টের জয়টা ছিল শুধুই একটি বড় জয়। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বের টিকিট তাতে মেলেনি। কিন্তু কাল অ্যাডিলেডে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ১৫ রানে হারিয়ে ইতিহাস গড়লেন মাশরাফিরা। ক্রিকেটের জনকদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ! মধুর জয়। মাশরাফিদের সেই জয়ের আনন্দে ভাসছে গোটা বাংলাদেশ। একটি জয়ে বাঙালিদের নতুন উৎসবের আবহ এনে দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ-রুবেলরা। লাল-সবুজের দেশ মেতেছে অ্যাডিলেডের কীর্তি নিয়ে। ২০০৭ বিশ্বকাপে সুপার এইটে খেললেও সেটা নকআউট পর্ব ছিল না। বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল যাত্রা তাই সবদিক থেকেই ঐতিহাসিক। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ফেভারিট হিসেবে মাঠে নামার চাপ সামলে কি দারুণভাবেই না বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন মাশরাফিরা! ব্যাটে-বলে প্রাপ্তিতে ভরপুর অসামান্য এক পারফরম্যান্স। অসাধারণ দুটি স্পেলে জোড়া আঘাতে ইংল্যান্ডকে শেষ করে দিলেন রুবেল হোসেন। তার আগে ঐতিহাসিক সেঞ্চুরিতে ঐতিহাসিক জয়ের ভিতটা গড়ে দেন মাহমুদউল্লাহ। তার ব্যাটেই ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে প্রথম সেঞ্চুরির স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহর ১০৩ ও মুশফিকুর রহিমের ৮৯ রানের দুর্দান্ত দুটি ইনিংসে ভর করে সাত উইকেটে ২৭৫ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়েছিল টাইগাররা। জবাবে বাংলাদেশের পেস আক্রমণের ত্রিরত্ন রুবেল, মাশরাফি ও তাসকিনের তোপের মুখে ৪৮.৩ ওভারে ২৬০ রানে অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। পাঁচ ম্যাচে চতুর্থ হারে বিশ্বকাপে দর্শক হয়ে গেল ইংল্যান্ড। আর পাঁচ ম্যাচে সাত পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ উঠে গেল পয়েন্ট টেবিলের তিনে। এখন শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে হারলেও কোনো সমস্যা নেই। ২৭৫ তাড়া করতে নেমে মঈন আলী ও ইয়ান বেলের উদ্বোধনী জুটিতেই ৪৩ রান তুলে ফেলেছিল ইংল্যান্ড। মঈন রানআউট হওয়ার পর অ্যালেক্স হেলসকে নিয়ে ৫৪ রানের জুটিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন বেল। ২০তম ওভারে হেলসকে ফিরিয়ে প্রথম আঘাত হানেন মাশরাফি। ৯৭ থেকে ১৩২ রানের মধ্যে চার উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যায় ইংলিশরা। ইংল্যান্ডের মূল সর্বনাশটা করেন রুবেল। ২৭তম ওভারে তিন বলের ব্যবধানে তিনি ফিরিয়ে দেন বেল (৬৩) ও মরগ্যানকে। সেই বিপর্যয় সামলে জস বাটলার (৬৫) ও ক্রিস ওকসের (৪২*) ব্যাটে যখন জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল ইংল্যান্ড, তখনই রুবেলের আরেকটি জোড়া আঘাত। ৪৯তম ওভারে ব্রড ও অ্যান্ডারসনকে ফিরিয়ে ইংল্যান্ডকে বোল্ড করে দেন রুবেল! ৫৩ রানে চার উইকেট নিয়েছেন তিনি। মাশরাফি ও তাসকিনের ঝুলিতে গেছে দুটি উইকেট। মাহমুদউল্লাহ ম্যাচসেরার স্বীকৃতি পেলেও জয়ের নায়ক তিনি একা নন। রুবেলের মতো মুশফিকও হতে পারতেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ব্যাট হাতে ৮৯ রান করার পাশাপাশি গ্লাভস হাতে নিয়েছেন চারটি ক্যাচ। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর মতো তাদের কীর্তি ঠিক ঐতিহাসিক নয়! এর আগে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের শুরুটা ছিল ভয়াবহ। জেমস অ্যান্ডারসনের জোড়া আঘাতে স্কোর বোর্ডে ৮ রান উঠতেই নেই দুই উইকেট! প্রথম ওভারেই অ্যান্ডারসনের বলে স্লিপে ক্রিস জর্ডানকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ইমরুল কায়েস। অ্যান্ডারসনের পরের ওভারে তামিম ইকবালও তার উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসেন। শুরুতেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যাওয়া বাংলাদেশকে কক্ষপথে ফেরান মাহমুদউল্লাহ ও সৌম্য সরকার। তৃতীয় উইকেটে ১৮ ওভারে ৮৬ রানের দারুণ এক জুটি গড়ে বিপর্যয় সামাল দেন তারা। উইকেটে জমে যাওয়া সৌম্যকে শর্ট বলে বিভ্রান্ত করে এই জুটি ভাঙেন ক্রিস জর্ডান। ৫২ বলে ৪০ করে সৌম্যর বিদায়ের পর সাকিবও দ্রুত ফিরে গেলে ফের চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। মঈন আলীর বলে জো রুটের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন সাকিব। দুই উইকেটে ৯৪ থেকে মুহূর্তেই স্কোর ৯৯/৪। এবারও বিপর্যয় সামাল দেয়ার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন মাহমুদউল্লাহ। তার সঙ্গী হলেন মুশফিকুর। শুধু প্রতিরোধ নয়, পাল্টা আক্রমণে ইংলিশদের দিশেহারা করে দেন দুই ‘ভায়রা ভাই’। পঞ্চম উইকেটে ১৪৪ বলে ১৪১ রানের রেকর্ড জুটি গড়ার পথেই ইতিহাস লেখেন মাহমুদউল্লাহ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে উপহার দেন প্রথম সেঞ্চুরি। সাত চার ও দুই ছক্কায় ১৩৮ বলে ১০৩ রান করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রানআউট হয়ে যান বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। কম যাননি মুশফিকুরও। আট চার ও এক ছক্কায় ৭৭ বলে ৮৯ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলেন মুশফিক। পঞ্চম উইকেটে মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকের ১৪১ রানের অনবদ্য যুগলবন্দিই বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ের ভিত গড়ে দেয়। পঞ্চম উইকেটে এটি বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের জুটি। আর বিশ্বকাপে যেকোনো জুটিতেই সর্বোচ্চ। দ্রুত রান তোলার তাড়া না থাকলে মুশফিকও তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে পারতেন। শেষদিকে তিন ওভারের মধ্যে মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক ও সাব্বির রহমানের (১৪) বিদায়ে সাত উইকেটে ২৭৫ রানে থামে বাংলাদেশের ইনিংস। সংগ্রহটা আরও বড় হতে পারত। কিন্তু হাতে পাঁচ উইকেট নিয়ে শেষ দশ ওভারে ৭৮ ও শেষ পাঁচ ওভারে ৩৮ রানের বেশি তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। অবশ্য তারপরও এটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। ইংল্যান্ডের পক্ষে দুটি করে উইকেট নেন অ্যান্ডারসন ও জর্ডান। শেষ পাঁচ ওভারে প্রত্যাশার চেয়ে কম রান ওঠার আফসোসটা পরে ঘুচিয়ে দিয়েছেন বোলাররা। ইংল্যান্ডকে ২৬০ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ চলে গেল স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইনালে। একই সঙ্গে বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল ইংল্যান্ডের।  

No comments:

Post a Comment