Monday, March 23, 2015

নাশকতার আগুনে প্রাণ গেল আরও ৪ জনের:প্রথম অালো

হরতাল ও অবরোধে সহিংসতার আগুনে প্রাণ গেল আরও চারজন নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষের। এঁদের মধ্যে তিনজনই মাগুরার বালুশ্রমিক। গতকাল রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে একে একে মারা যান তিনজন। এক দিনে দুর্বৃত্তদের পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে এ হাসপাতালে এত জনের মৃত্যু আর হয়নি। সম্প্রতি পেট্রলবোমা হামলা কিছুটা কমে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস দেখা যাচ্ছিল। তবে কয়েক দিন ধরে হঠাৎই
যেন এই বোমা হামলা আবার বেড়ে গেছে। এতে জীবিকার জন্য ঘর থেকে বেরোতে বাধ্য হওয়া লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে আগের সেই উৎকণ্ঠা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের টানা অবরোধের ৭৬তম দিন ছিল গতকাল। এদিন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বাসসহ তিনটি গাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। রাজশাহীতে পোস্ট অফিসেও আগুন দিয়েছে তারা। ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে চলছে এ অবরোধ। তবে এর দুই দিন আগে থেকেই শুরু হয় সহিংসতা। ‘ক্রসফায়ারে’ ৩৩ জনসহ গতকাল পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন; আহত ব্যক্তির সংখ্যা সহস্রাধিক। আগুন দেওয়া হয়েছে ৭৩৪টি যানবাহনে এবং ভাঙচুর করা হয়েছে ৬৬১টি। এদিকে নাশকতায় জড়িত থাকার সন্দেহ, মামলা ও অন্যান্য ঘটনায় গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে ৮৩ জনকে। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও ঢাকার বাইরে সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর: এক দিনে চারজনের মৃত্যু: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিচতলায় একসঙ্গে অনেকগুলো পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের ওপর ভর করে কাঁদছিলেন গতকাল। এঁরা সবাই মাগুরার মঘিরঢালের বাসিন্দা। এঁরা একই দুঃখে দুঃখী। এঁদের উপার্জনক্ষম সন্তানেরা একই সঙ্গে বালুর ট্রাক নিয়ে বেরিয়েছিলেন। পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে একসঙ্গে বার্ন ইউনিটে এসেছেন। কেউ মারা গেছেন, কেউ মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। গতকাল এ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজন ও এখানে আনার পথে মারা গেছেন একজন। তাঁদের তিনজনই মাগুরার দিনমজুর, একজন যশোরের ব্যবসায়ী। সকাল সাতটায় এখানে মাগুরার মালিকগ্রাম থেকে ভর্তি হন দগ্ধ আটজন। তাঁদের মধ্যে দুপুর ১২টার দিকে মারা যান শাকিল মোল্লা (২০) ও চারটার দিকে আবদুল মতিন বিশ্বাস (২৫)। সহযাত্রী রওশন আলী (৪০) বার্ন ইউনিটে পৌঁছানোর আগেই ভোর চারটার দিকে মারা যান। এদিকে যশোরের ঝিকরগাছার ব্যবসায়ী শরীফ মারা যান বেলা তিনটার দিকে। শরীরের ৮৮ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল তাঁর। ১৯ মার্চ চালকের পাশে বসে নিজের ট্রাকে করে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। সেখান থেকে চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাটের দিকে আসার পথে চাঁদপুরের চান্দ্রা সড়কে রাত ১২টার দিকে দুর্বৃত্তরা ট্রাকটিতে পেট্রলবোমা ছোড়ে। শরীফের স্বজন শাহ সেকান্দার জানান, ধার করে ট্রাক কিনেছিলেন যশোরের ঝিকরগাছার শরীফ। ঋণ শোধ করেছেন গেল সপ্তাহে। অনেক সাধের ট্রাক। হরতাল-অবরোধে যদি পুড়ে যায়—এ ভয়ে বের করেননি ট্রাকটি। কিন্তু কত দিন বসে থাকবেন। সাত, পাঁচ আর দেড় বছরের তিন সন্তান, বৃদ্ধ মা যার ওপর নির্ভরশীল, তিনি কত দিনই বা আর বসে থাকতে পারেন। তাই ঝুঁকি নিয়েই বেরিয়েছিলেন। চালকের পাশে বসে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। সেখান থেকে চাঁদপুরের দিকে। এটাই কাল হলো তাঁর। এদিকে গত শনিবার একসঙ্গে মাগুরা থেকে শালিখা উপজেলার ভাটোখালী গ্রামে ট্রাকে বালু নিয়ে গিয়েছিলেন জেলার মঘিরঢালের নয় বাসিন্দা। বালু নামিয়ে সন্ধ্যার পর ফিরছিলেন তাঁরা। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে খালি ট্রাকের ভেতর ক্লান্তিতে গা এলিয়ে ফিরছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মাগুরা-যশোর মহাসড়কে মাগুরা সদর উপজেলার মঘিরঢাল এলাকায় দুর্বৃত্তরা ট্রাকটিতে দুটি পেট্রলবোমা ছোড়ে। এতে প্রত্যেকেই গুরুতর দগ্ধ হন। সকালে রওশনের মৃত্যুর পর থেকেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে ওঠেন স্বজনেরা। একে একে মারা যান আরও দুজন। তখন বার্ন ইউনিটের নিচতলায় শাকিলের মা মনজিলা বেগমকে দুই পাশ থেকে চেপে ধরে রেখেছিলেন দুই স্বজন। জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা। ছেলের টাকায় সংসার চলত, অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেটির লেখাপড়া হতো। ভাষাহীন মনজিলা মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছিলেন। ঘণ্টা চারেকের মাথায় মতিন বিশ্বাসের মৃত্যুর খবর আসে। মনজিলা ছুটে যান মতিনের স্ত্রী জাহিদার কাছে। জাহিদার পায়ে স্যান্ডেল পর্যন্ত নেই। চিৎকার করে কাঁদছিলেন শুধু, আর বলছিলেন, ‘মণি থুয়ে কই গেলা গো। ও আল্লাহ!’ জাহিদার দুই বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। দগ্ধ ইয়াদুলের অবস্থাও খুব খারাপ। ইয়াদুলের অবস্থা মাকে জানানোর সাহস পাচ্ছিলেন না ফুফু হাসিয়া বেগম। পাঁচ বোনের পর ইয়াদুলের জন্ম। আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে তিনি। তাই খুব অল্প বয়সে হাল ধরতে হয়েছে তাঁকে। হাসিয়া বলেন, ‘ওর মাকে শুধু জানিয়েছি ছেলে আছে। কোনো আশা নাই সে কথা বলবার সাহস পাইনে।’ জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামন্তলাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে একসঙ্গে এত জন এতটা দগ্ধ হয়ে আসেননি বার্ন ইউনিটে। জানা গেছে, দগ্ধদের প্রত্যেককে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা প্রয়োজন হলেও জায়গা না থাকায় রাখতে হয়েছে সার্বক্ষণিক পরিচর্যা কেন্দ্রে (এইচডিইউ)। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা জানান, বর্তমানে এখানে চিকিৎসাধীন মাগুরার ছয়জন রোগীর তিনজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। এদের মধ্যে ইয়াদুলের (২৫) শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীর (৩০) ৫০ শতাংশ এবং ইমরানের (৩০) ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে। চিকিৎসকেরা আরও জানান, নাজমুল (৩০), ফারুক (৩০) ও আরব আলীর (২৩) দেহের ২০ থেকে ২৯ শতাংশ পুড়েছে। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। প্রত্যেকের শ্বাসনালি গভীরভাবে পুড়েছে। গতকাল আসরের নামাজের পর জানাজা শেষে বালুকাটা শ্রমিক রওশনকে নিজ গ্রামের গোয়ালবাড়ি কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। মাত্র দুই মাস আগে তাঁর বাবাও মারা যান। মালিকগ্রামে মাতম: মাগুরা সদর উপজেলার মালিকগ্রামে চলছে মাতম। শনিবার ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় চালকসহ দগ্ধ নয়জনের মধ্যে আটজনই বালুশ্রমিক। এ আটজনই মালিকগ্রামের বাসিন্দা। গতকাল সকালে মাগুরা শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মালিকগ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামজুড়ে চলছে মাতম। হতাহত আট শ্রমিকের বাড়ি পাশাপাশি। স্বজনদের বিলাপে ভিড় জমানো গ্রামবাসীদের কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এসব শ্রমিকের কুঁড়েঘর ছাড়া কিছুই নেই। পেট্রলবোমায় দগ্ধ শ্রমিকদের চারজনই একই পরিবারের। তাঁরা হলেন নিহত রওশন আলী, তাঁর ভাই দগ্ধ ইলিয়াস বিশ্বাস এবং ভাতিজা আবদুল মতিন (নিহত) ও দগ্ধ আরব আলী। রওশন আলীর মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ স্ত্রী শুকুরন্নেছা তিন শিশুসন্তানকে জড়িয়ে শুধু অপলক তাকিয়ে ছিলেন। একপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে উঠে শুকুরন্নেছা শুধু বলেন, ‘আমি তিন নাবালককে কীভাবে বাঁচাব? ওরা কেন আমাগের সর্বনাশ করল? আমরা ওগের কী ক্ষতি করিছি?’ পাশে রওশনের দুই বোন বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন। উঠানে গড়াগড়ি খেয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। নিহত আবদুল মতিনের স্ত্রী জাহিদা খাতুন বলেন, ‘খুব সকালে বার হয়। বালির কাজ করে দিনি ৩০০ টাকা পায়। তাই দিয়েই কষ্টে সংসার চালাই। এখন আমার সব শেষ। কীভাবে আমরা বাঁচপো?’ দগ্ধ ইয়াদুলের চাচা তরিকুল ইসলাম কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ইয়াদুলের কোনো ভাই নেই; ছয় বোন। কাজ শেষে চাল-ডাল কিনে বাড়ি ফিরলে তবেই সবার খাওয়া হতো। ঢাকায় তিনটি গাড়িতে আগুন: গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ফার্মগেট-সংলগ্ন তেজগাঁও কলেজের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বহনকারী বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাস ও রাত ১০টার দিকে মিরপুর অরিজিন্যাল ১০ নম্বরে ইউনাইটেড পরিবহনের একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। যাত্রীরা দ্রুত নেমে পড়ায় কেউ হতাহত হননি। একই দিন ভোর চারটার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি মিনিবাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ঢাকার বাইরের আরও চিত্র: রাজশাহীর বাঘা উপজেলা সদর পোস্ট অফিসে গত রাতে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। স্থানীয়রা পাশের দীঘি থেকে পানি এনে দ্রুত আগুন নেভান। যশোরের অভয়নগর উপজেলার বুইকরা গ্রামে গতকাল সন্ধ্যায় বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে আবদুল্লাহ আল মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আবদুল্লাহ আল মামুন বিএনপির কর্মী বলে দাবি করেছে পুলিশ। নোয়াখালীর সেনবাগের সেবারহাট পশ্চিম বাজারের ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কে গত শনিবার রাতে বালুবোঝাই একটি ট্রাকে ইটপাটকেল ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রাকের সামনের কাচ ভেঙে গেছে এবং চালক মো. মামুন আহত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ২০টি পেট্রলবোমাসহ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে পৌর শহরের পশ্চিম মথুরাপুর এলাকা থেকে এসব উদ্ধার করা হয়। গাজীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তেলিপাড়া এলাকা থেকে ছয়টি পেট্রলবোমাসহ গতকাল বিকেলে দুই যুবককে গ্রেপ্তারের দাবি করেছে র্যাব।

No comments:

Post a Comment