ক্ষীণ হয়ে আসছে সমঝোতার আশা। নানামুখী চাপ সত্ত্বেও হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করছে না বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ওদিকে সংলাপেও রাজি হচ্ছে না সরকারি দল আওয়ামী লীগ। উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে। গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে জোটের পক্ষে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। আর সরকারি দলের পক্ষ থেকে সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী
ও ‘জঙ্গিনেত্রী’র সঙ্গে সংলাপ হবে না। ফলে চলমান রাজনৈতিক সংকট সহসাই দূর হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছেন ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকরাও। সব মিলিয়ে গত ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত থাকতে পারে বলেই পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, বড় দুই দল এবং এর নেতারা যেভাবে অনড় অবস্থান দেখাচ্ছেন তাতে আলোচনা বা সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং তাঁদের বক্তব্যে জনগণের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন সেক্টরে যে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা দেখে দুই নেত্রীর বোধোদয় না হলে করার কিছু নেই। দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে যদি জনমত গড়ে ওঠে তবেই কেবল এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, বিএনপি চেয়ারপারসন, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য শুনলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সংলাপ ও সমঝোতা অনেক দূর। তাঁদের এই বক্তব্যের মধ্যেও রাজনীতি আছে। এ ছাড়া সংলাপ করে এ দেশে আগেও কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছে। এখন সরকারপক্ষকে তৃতীয় একটি ফর্মুলা দিতে হবে। একেবারে কিছুই না করে সরকার ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা টেনে নিয়ে যাবে, এটা বোধ হয় সম্ভব নয়। অনড় অবস্থানে বিএনপি : বিএনপি, জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমান সংকট নিয়ে দেশের জনগণের ভোগান্তির কথা তাঁদের মাথায় থাকলেও ‘ছাড়’ দেওয়ার কোনো চিন্তা নেই। এমনকি ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপের সূত্র ধরে আন্দোলন সাত দিনের জন্য স্থগিত করার পরিকল্পনাও তাঁদের নেই, যদিও বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা আছে। কিন্তু সাত দিনের জন্য বা একবার আন্দোলন স্থগিত করা হলে তা আবার শুরু করা কঠিন বলে ২০ দল মনে করে। এ ছাড়া তাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো- আন্দোলন স্থগিত করামাত্রই ২০ দলীয় জোটের ওপর সরকার ‘ক্র্যাকডাউন’ শুরু করবে। দেশব্যাপী চালাবে ধরপাকড়। আর এ জন্যই ‘আগে আন্দোলন (সরকারের ভাষায় সহিংসতা) বন্ধ এবং পরে সংলাপ শুরু’ সরকারের প্রকাশ্যে বলা এ প্রস্তাবে তারা রাজি হচ্ছে না। সূত্র মতে, ১৬ জন বিদেশি কূটনীতিকের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে একই সঙ্গে দুই ঘোষণা অর্থাৎ আন্দোলন বন্ধ ও সংলাপ শুরুর ঘোষণা দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রস্তাবে সরকারপক্ষ রাজি হয়নি। তারা আগে সহিংসতা বন্ধের পক্ষে অনড় অবস্থানে আছে। একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, গত ৩ মার্চ ১৬ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে খালেদা জিয়া স্পষ্ট করে বলেছেন, আন্দোলন স্থগিত করলে ওরা (সরকার) বিএনপিকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেবে। এ ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী আন্দোলন স্থগিত করার পর ধরপাকড়ের চিত্র ও যুক্তি তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে সমঝোতার শর্ত হিসেবে আগে সংলাপ এবং নেতা-কর্মীদের মুক্তির পাশাপাশি সভা-সমাবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্ত জুড়ে দেন। এদিকে দল, জোটগত এবং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশেও আন্দোলন পেছানোর আর সুযোগ নেই বলে মনে করছে বিএনপি। তাদের মতে, কোনো ‘প্রাপ্তিযোগ’ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন পেছানোর অর্থ আওয়ামী লীগের কাছে হার মানা; এককথায় রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হওয়া। ফলে এ যাত্রার আন্দোলনে যা-ই ঘটুক, ছাড় দেওয়ার কোনো চিন্তা খালেদা জিয়ার নেই। দলটির নেতাদের ভাষায়- বিএনপির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সমঝোতা ছাড়া এখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। এমনকি খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হলেও দলটি আন্দোলন পেছাবে না বলে জানা গেছে। দলটির নেতাদের মতে, খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলে আন্দোলন আরো চাঙ্গা হবে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী এবং এলজিআরডিমন্ত্রী যেভাবে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন, এর পর তো সমঝোতার আর কোনো সম্ভাবনা দেখি না। তাঁর মতে, সভা-সমাবেশ এবং নেতা-কর্মীদের মুক্তির বিষয়ে খালেদা জিয়ার দাবি খুবই ন্যায্য। কারণ তাদের কারাগারে রেখে তিনি আন্দোলন বন্ধ কিংবা সমঝোতা কোনোটাই করতে পারেন না। তবে বিএনপির আন্দোলনে বৈচিত্র্য দরকার বলে তিনি মনে করেন। এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, এটা অত্যন্ত হতাশাজনক যে আন্দোলনের ৬৮ দিন হয়ে গেল অথচ কোনো ফল পাওয়া গেল না। কারণ দুই পক্ষই অনড়। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির ও ২০ দলের পক্ষ থেকে যা বলার জোট নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন। এখন সাড়া দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তারা ক্ষমতায় আছে। সুতরাং সংকট সমাধানে তাদেরই দায়িত্ব বেশি। এটা সরকারি দল অস্বীকার করতে পারবে না। ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ : এদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ও সরকার বিএনপিকে তাদের তুলনায় সাংগঠনিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল বলে মনে করে। পাশাপাশি এ দলের কমিটমেন্টও তাদের তুলনায় কম বলে মূল্যায়ন আওয়ামী লীগের। এ কারণেই বিএনপির আন্দোলনের ব্যাপারে অনেক সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সূত্র মতে, সরকারের বড় একটি অংশ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের মতোই কৌশলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পক্ষে। যদিও এ ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি আছে- এমন মতামতও রয়েছে। পাশাপাশি আগেরবারের তুলনায় এবারকার আন্দোলনে সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপও কিছুটা বেড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তা সত্ত্বেও বিএনপির দাবি অনুযায়ী সংলাপে রাজি হলে রাজনৈতিকভাবে তাদের পরাজয় ঘটবে বলে সরকারের ধারণা। এ ছাড়া ওই ধরনের পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হয়। ফলে পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে পরিস্থিতি সামলাতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে সামাল দেওয়ার জন্য একদিকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে; পাশাপাশি ঘটনাপ্রবাহের বিচার-বিশ্লেষণ ও প্রমাণ-আলামতসহ এমন প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা হয়েছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পরিষ্কার করা যায় যে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটের কর্মকাণ্ড ‘জঙ্গিবাদ’ ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জনমত পক্ষে নিতে হাতে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প। পাশাপাশি সমাজের ক্ষমতার বিকল্প বিভিন্ন কেন্দ্রগুলোকে কাজে লাগানোরও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সরকারের পক্ষে বৃদ্ধি করা হয়েছে প্রচার-প্রচারণা। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ মনে করছে, এসব প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে আরো অন্তত দুই বছর ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে। এরপর সুবিধাজনক একটি সময়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যাবে। বিএনপির আন্দোলন বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণেই প্রতিপক্ষ জোটের দুই মাস আট দিনের লাগাতার আন্দোলনের পরেও অনড় অবস্থানে রয়েছে সরকার। আবার এর আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কয়েকবার আগ বাড়ানো পদক্ষেপ বিশেষ করে, একবার খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার টেলিফোন করা এবং ও-প্রান্ত থেকে কড়া ভাষায় জবাব পাওয়া; আরেকবার খালেদার ছোট ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে শেখ হাসিনার তৎপরতা আর খালেদা জিয়ার বাসার গেট না খোলা- এই দুটি ইস্যুও সরকার পক্ষের সংলাপে সাড়া না দেওয়ার বড় কারণ হয়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতে, এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি রেললাইনের মতো। দুটি কখনো এক জায়গায় মিশবে না। সংলাপ বা সমঝোতাও হবে না। কেন হবে না- জানতে চাইলে বিশিষ্ট এই পার্লামেন্টারিয়ান বলেন, খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের কারণে। তাঁরাই পরিস্থিতি আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছেন। বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী তাঁদের সঙ্গে নেই। মা ও ছেলে মিলে আন্দোলন করছেন বলেও দাবি করেন তিনি। এর আগে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পেশাজীবীদের এক মহাসমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে খালেদা জিয়ার সংলাপের দাবি প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘উনার (খালেদা জিয়ার) সঙ্গে কিসের সংলাপ? যাঁর হাতে রক্ত, পোড়া মানুষের গন্ধ, যিনি জঙ্গিদের নেত্রী, সেই খুনির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না।’ সকালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা চলতে থাকলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবে না। বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসীগোষ্ঠী’ অভিহিত করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
No comments:
Post a Comment