দীর্ঘদিন বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ও দিয়েছেন। অথচ সব সময় ন্যায়ের পক্ষে থাকা লোকটিই এবার চরম প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সঞ্চয়ের টাকা আর ধারদেনা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন পূর্বাঞ্চল প্রকল্পের তিন কাঠার একটি প্লট কিনেছিলেন। ইতিমধ্যে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধও করেছেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি মতিঝিলে রাজউক ভবনে এসেছিলেন বিক্
রয় অনুমতি নিতে। এসেই মাথায় হাত! তাঁকে জানানো হলো, প্লটটি তাঁর আগে আরো চারজনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, দালালের মাধ্যমে প্লট কিনে তাঁর মতো আরো অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সংগত কারণে বিচারক তাঁর নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানালেন। তিনি পূর্বাচলের পরিচালক আহসান ইকবালের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পরপরই ঢুকলেন আরেকজন। নাম আশরাফুল আলম, বাসা টঙ্গী এলাকায়। জানালেন, ১৫ বছর মধ্যপ্রাচ্যে চাকরিজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে পূর্বাচল থেকে একটি প্লট কিনেছেন। প্লট কিনে রেজিস্ট্রেশন করে এখন নাম জারি করতে গিয়ে আটকে গেছেন। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই প্লটের আরো কয়েকজন দাবিদার রয়েছেন। তাঁরা রাজউক কর্তৃপক্ষের কাছে নিজের অংশ পেতে আবেদন করেছেন। বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটছে অধিবাসী বা ক্ষতিগ্রস্ত প্লট কেনাবেচার ক্ষেত্রে। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পূর্বাঞ্চল প্রকল্পে স্থানীয় যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ৩১ কাঠার বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রকল্পের পক্ষ থেকে তিন কাঠার একটি করে প্লট দেওয়া হয়েছে। এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে অধিবাসী বা ক্ষতিগ্রস্ত প্লট। জমি অধিগ্রহণের সময় এসব ব্যক্তিকে দালিলিক প্রমাণপত্র (অ্যাওয়ার্ড) দেওয়া হয়েছে, যা দেখিয়ে পরবর্তী সময়ে তাঁরা রাজউক থেকে প্লট নিয়েছেন। অভিযোগের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রাজউকের আওতাধীন বৃহৎ প্রকল্প পূর্বাচলকে ঘিরে একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন লোকজনের কাছে ‘অধিবাসী’ ক্ষতিগ্রস্তদের নামের অ্যাওয়ার্ড বিক্রি করে, যেগুলোর বেশির ভাগই ভুয়া। আবার যেগুলো সঠিক সেগুলোও একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে পূর্বাচল সেল গড়ে ওঠার পর থেকে এ পর্যন্ত শত শত মানুষ এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি রাজউক থেকে একটি প্লট কিনেছি। পরবর্তী সময়ে জানতে পারি- এ প্লটের আরো দুইজন দাবিদার রয়েছেন। আমি যার মাধ্যমে প্লট কিনেছি সে ব্যক্তি সব সময় পূর্বাচল প্রকল্পের এস্টেট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রুমে বসে থাকে। ফলে সহজেই তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। প্রতারিত হওয়ার পর জানতে পারি সে রাজউক কর্মকর্তাদের বিশ্বস্ত দালাল।’ রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের উপপরিচালক (এস্টেট-৩) মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মিয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অধিবাসী বা ক্ষতিগ্রস্ত প্লট কিনে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ প্রায়ই আসছে। কিন্তু ঘটনা যখন আমরা শুনি ততক্ষণে তো ক্রেতারা টাকা-পয়সা সব দিয়ে দেন। যাঁরা জমি কিনছেন তাঁদের উচিত লেনদেনের আগে জমির সঠিক মালিকানা সম্পর্কে জেনে নেওয়া।’ জানা যায়, রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে প্রায় ২০ জন দালাল রয়েছে, এদের বেশির ভাগই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বাসিন্দা। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর অধিবাসী বা ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট কেনাবেচার নামে এসব দালালের বিস্তার ঘটে। বর্তমানে রাজউক ভবনের পূর্বাচল সেলে মারফত, দেলোয়ার, ফারুক মালুম, শাহিন মালুম, রমজান, হাসমত, আনোয়ার, উকিল আনোয়ার, আনসার আলী, মজিবুর, মামুন, রিপন ও রাসেল দালাল হিসেবে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে বেশির ভাগ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পূর্বাচল সেলে চাকরির শুরু থেকেই কর্মরত আছেন সহকারী পরিচালক রাজিয়া সুলতানা (্এ্যানি) ও হাবিবুর রহমান। ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। রাজিয়া সুলতানা পূর্বাচলের ৯ নম্বর সেক্টরে একটি প্লটও কিনেছেন। হাবিবুর রহমানকে দুই মাস আগে উত্তরার রাজউক অফিসে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছিল। সেই আদেশ বাতিল করে তিনি পুরনো কর্মস্থলেই রয়েছেন। তবে যোগাযোগ করা হলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত না। কোনো প্রতারকচক্রের সঙ্গেও সম্পর্ক নেই।’ অভিযোগ অনুযায়ী, এ সেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়েই সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ সিন্ডিকেটই প্লট কেনাবেচা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক (এস্টেট-৩) মোহাম্মদ আহসান ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, ‘দালালদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ আমাদের রুমেও আসে না। বাইরে থেকেই লোকজনকে কেউ কেউ আশ্বস্ত করে প্লট বিক্রির নামে প্রতারণা করে। আমরা সব কিছুই নজরে রেখে দালালদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।’ জানা যায়, রাজউকের পূর্বাচলে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয় প্লটের আকার ও সেক্টর পরিবর্তনে। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান প্লট পরিবর্তন বন্ধ করার পর ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অ্যাওয়ার্ড জালিয়াতি করেন রাজউক ও জেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ইতিপূর্বে একটি জালিয়াতচক্র এভাবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পূর্বাচল প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৮০০ ভূমি মালিকের অ্যাওয়ার্ড জালিয়াতচক্র হাতিয়ে নিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছে। এরপর কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এবার অধিবাসী বা ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বিক্রির নামে শুরু হয়েছে নতুন প্রতারণা। ভুক্তভোগীদের দাবি, কর্তৃপক্ষের উচিত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী পূর্বাচল সেলে দীর্ঘ সময় আছেন তাঁদের অন্যত্র বদলি করা এবং চিহ্নিত দালালদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া। এ ব্যাপারে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাঁরা প্রতারিত হচ্ছেন তাঁদের বেশির ভাগই প্রবাসী। তাঁরা দালালের মাধ্যমে অধিবাসী প্লট কেনার পর মূলত রাজউক ভবনে এসে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। তাই সবার কাছে আমাদের আহ্বান- যেকোনো প্লট কেনার আগে রাজউক থেকে সঠিক তথ্য জেনে নিন। এ ব্যাপারে জনসচেতনার জন্য প্রয়োজনে আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিব।
No comments:
Post a Comment