সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে হাতে ধরা নোটবুকটা খুলে পাতার পর পাতা উল্টে গেলেন তিনি। নিজ হাতে লেখা মনের যত কথা সাজাতে গিয়ে প্রত্যেকটা পাতায় কত যে কাটাছেঁড়া! বোঝাই যাচ্ছিল যে সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক হয়ে গতকাল দুপুরে ঢাকায় ফেরার পথে ফ্লাইটের পুরোটা সময়ই খুব গোছানো বক্তব্য লেখায় মগ্ন ছিলেন আ হ ম মোস্তফা কামাল। শুরুও করলেন সেই নোটবুকটি খুলে ধরেই। তাঁর ভাষায় 'এক ঐতিহাসিক মুহূর্তকে কেন্দ্র করে' শাহজালাল আন্তর্
জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের উদ্দেশে লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে শুরু করলেন। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির নতুন চেয়ারম্যান এন শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগের পাহাড় তুলতে তুলতে বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী নতুন এক ইতিহাসের জন্মও দিলেন। আইসিসির মতো বৈশ্বিক ফোরামের সভাপতির পদ থেকে এর আগে তো কেউ কখনো স্বেচ্ছায় সরে যাননি। আরো তিন মাস মেয়াদ থাকতেই ২৯ মার্চ মেলবোর্নে বিশ্বকাপ ফাইনালের পর ট্রফি দেওয়া নিয়ে অন্যায়, অনিয়ম এবং গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করে আইসিসিকে আরো প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়ার ঘটনা তো এই প্রথম। পৌনে এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে তিনি অজস্রবার শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তবে আদালতের রায়ে নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়া আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি চেন্নাই সুপার কিংস এবং ইন্ডিয়া সিমেন্টসের কর্ণধারের নাম উচ্চারণ করেননি কখনোই। পচা, নোংরা, কুৎসিত, মস্তিষ্ক বিকৃত ও দুর্গন্ধময়- এসব বিশেষণেই শ্রীনিবাসনকে সম্বোধন করে পুরো সংবাদ সম্মেলনে তাঁর অনিয়মের ফিরিস্তি দেওয়া কামাল এক পর্যায়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছেও জানতে চান, 'ধরে নিন, আমার পদত্যাগপত্র তৈরি। এটা চলে যাবে। আপনারাই বলুন, যা যা বললাম তার ভিত্তিতে পদত্যাগ করা উচিত কি না।' কিছুক্ষণের জন্য নেমে আসা নীরবতা ভেদ করে কয়েকজনের মুখে 'উচিত' উচ্চারিত হতে শুনেই কামাল বলেন, 'তাহলে এখন যে বক্তব্য দেব, সেটা আইসিসির সাবেক সভাপতি হিসেবে।' এরপর বৈশ্বিক মিডিয়ার জন্য ইংরেজিতে লেখা একটি বিবৃতিও পড়ে শোনান তিনি। এর আলোচিত অংশটি এ রকম, 'কয়েক মুহূর্ত আগেই আইসিসি সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলাম আমি। কারণ এখানে একজন লোকের সঙ্গে কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল, সব জায়গায়ই যাঁর ব্যক্তিগত সততা প্রশ্নবিদ্ধ। গত ২৯ মার্চ যিনি বেআইনি ও অগঠনতান্ত্রিক উপায়ে ২০১৫ বিশ্বকাপের ট্রফি হস্তান্তর করেছেন। অথচ আইসিসির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বৈশ্বিক ইভেন্টের ট্রফি দেওয়ার অধিকার শুধুই সভাপতির, আর কারো নয়। আমি সরে দাঁড়ালাম যাতে সারা বিশ্ব আমার পদত্যাগের পেছনের সত্যিটা জানে। বিশ্বকে জানাতে চাই কিভাবে আইসিসির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এর গঠনতন্ত্র লঙ্ঘিত হলো।' সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আইসিসির প্রধান নির্বাহী বরাবর ই-মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েও দেন কামাল। সেটির প্রাপ্তি স্বীকার করে সন্ধ্যায় দেওয়া আইসিসির বিবৃতি অবশ্য বিস্ময় হয়েই এসেছে। দুপুরে অভিযোগের স্তূপ করে ফেলা কামালের পদত্যাগপত্রের ভাষা তুলে ধরে আইসিসির বিবৃতিটা এ রকম, 'প্রধান নির্বাহী বরাবর দেওয়া পদত্যাগপত্রে কামাল ব্যক্তিগত কারণে সরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আইসিসি সংশ্লিষ্ট সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি এও যোগ করেছেন যে কারো বিরুদ্ধেই তাঁর কোনো অভিযোগ নেই।' তাহলে দুপুরে যে এত অভিযোগ করলেন? কামাল পদত্যাগপত্রে তেমন কিছু না লেখার ব্যাখ্যাও দিলেন সন্ধ্যায়, 'প্রধান নির্বাহীর কাছে এত কথা লিখতে যাব কেন? পদত্যাগের পেছনে হাজারটা কারণ থাকতে পারে। সেসব ওখানে লেখার কী দরকার? তা ছাড়া চাকরিচ্যুতির সময় কী কী কারণে করা হলো, সেটি লিখে দেওয়া হয়। তবে পদত্যাগের সময় ব্যক্তিগত কারণ দেখানোই নিয়ম। আমি তাই করেছি। অভিযোগের কথা যেখানে বলার দরকার, সেখানেই বলেছি। বিবৃতি দিয়ে তো আমি সারা বিশ্বকে জানিয়েই দিয়েছি যে কেন পদত্যাগ করলাম।' বাংলাদেশের ক্রিকেটের পক্ষে কথা বলার জন্যই তিনি শ্রীনিবাসনদের রোষানলে পড়েছেন জানিয়ে কামাল কাল দুপুরে বলছিলেন, 'আমি বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছি। এঁদের (শ্রীনিবাসনদের) কথা হলো, আমি তা বললাম কেন? কিন্তু আমার কাছে দেশ আগে। আইসিসি সভাপতির আগে দেশ। সে জন্যই আমি দেশের পক্ষে কথা বলেছি।' বলেছিলেন ১৯ মার্চ মেলবোর্নে ভারত-বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালের পর। যেদিন কামাল মাঠে গিয়ে দেখেন 'স্পাইডার ক্যাম' নেই। সেই সঙ্গে জায়ান্ট স্ক্রিনও বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয় তাঁকে, ''জায়ান্ট স্ক্রিনের মালিক আইসিসি। আমরা যখন বিশ্বকাপ করেছি, তখন পোস্টার ছাপাতে গিয়ে প্রত্যেকটা দাড়ি, কমার অনুমোদনও আইসিসির কাছ থেকে নিতে হয়েছে। নিজেদের মতো কিছু করতে পারিনি। অথচ সেদিন দেখি জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা উঠছে, 'ইন্ডিয়া জিতেগা'। সঙ্গে সঙ্গে আইসিসির প্রধান নির্বাহীকে বললাম এসব বন্ধ করতে। কিন্তু বন্ধ করা হলো না।'' সেই সঙ্গে যুক্ত হতে থাকল আম্পায়ারিংয়ের নানা ভুলও। প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার নিয়েও ক্ষুব্ধ কামাল ম্যাচের পর সংবাদমাধ্যমে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণও ঘটান, 'বাংলাদেশ না হয়ে অন্য কোনো দলের বিপক্ষে ওরকম হলেও আমি সেদিন নিজের পর্যবেক্ষণ জানাতাম। তা ছাড়া আমি শুধু সভাপতিই নই, একজন মানুষও। আমার নিজস্ব আবেগ ও আত্মসম্মান আছে। আমি বিশ্ব ও বাংলাদেশের ক্রিকেট অন্তপ্রাণ মানুষ। সংগত কারণেই আমার প্রতিবাদ যে স্বরে হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে একটু উচ্চস্বরেই হয়েছে।' সেটির সূত্র ধরেই ২৯ মার্চের ফাইনালের আগের দিন বিকেলে হঠাৎ করেই সভা ডেকে বসেন শ্রীনিবাসন। সেখানে প্রথমে কামালকে নিজের বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিতে বলা হয়। তিনি সম্মত না হওয়ায় দেওয়া হয় বক্তব্য প্রত্যাহারের বিকল্প প্রস্তাব, কিন্তু 'আমি জানিয়ে দেই যে বক্তব্য প্রত্যাহার করব না। কারণ আমার বক্তব্য ছিল ১৬ কোটি মানুষের মনের কথাও। তাঁদের বাদ দিয়ে তো আমি বক্তব্য প্রত্যাহার করতে পারি না।' এর পরই কামালকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে পরদিন বিজয়ী অধিনায়কের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না। সংবিধান লঙ্ঘনের কথা তুলেও শ্রীনিবাসনকে টলাতে না পারা কামালকে তাই বলতেই হলো, 'গায়ের জোরে আমার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অসাংবিধানিকভাবে, অনৈতিকভাবে।' মেলবোর্নে থাকতেই এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তবে দেশে ফিরে কামাল অবস্থান পাল্টেছেন, 'আমাকে অন্তত ১০০ জন অনুরোধ করেছেন যেন মামলা করি। কিন্তু আমি এখন মামলার পক্ষে না। কার বিরুদ্ধে মামলা করব? এক-দুজনের দোষ তো আর পুরো আইসিসির ওপর চাপতে পারে না।' তাই মামলা না করে তিনি এমন কিছুই করতে চেয়েছেন, যা বিচারের পথ দেখাবে বলেই বিশ্বাস কামালের, 'আমি চাই আমার পদত্যাগের কারণ মানুষ গবেষণা করুক। গবেষণা করলেই বুঝতে পারবে আইসিসি আসলে কারা চালাচ্ছে। বাজে লোকদের সরানোর পথটা আমি দেখিয়ে দিলাম। একটি বিচার হওয়ার রাস্তাও তৈরি করে দিলাম।' বিচারের বাণী যাতে নিভৃতে না কাঁদে, সেজন্য শ্রীনিবাসনদের একরকম ক্রিকেট বিশ্বের জনতার আদালতেই যেন দাঁড় করিয়ে দিলেন কামাল!
No comments:
Post a Comment