Thursday, April 2, 2015

আইসিসি ছাড়লেন ক্ষুব্ধ কামাল:প্রথম অালো

অস্ট্রেলিয়ায় বলা কথাবার্তাতেই বোঝা যাচ্ছিল, দেশে ফিরে কোনো চমক দেবেন। হতে পারে সেটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সভাপতি পদে ইস্তফা দেওয়ার মতো নাটকীয় কিছুও। কাল দুপুরে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে সেটাই করলেন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে আগে থেকে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিলেন আইসিসির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের।
আইসিসিও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মুস্তফা কামালের পদত্যাগপত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করেছে। ১৫ ও ১৬ এপ্রিল দুবাইয়ে অনুষ্ঠেয় বোর্ড সভায় সভাপতির শূন্য পদ পূরণ নিয়ে আলোচনা হবে বলেও জানানো হয়েছে তাতে। দুই বছর সহসভাপতি থাকার পর আইসিসির সভাপতি হিসেবে মুস্তফা কামালের এক বছরের মেয়াদ শেষ হতো আগামী ৩০ জুন। মুস্তফা কামাল পদত্যাগ করলেও আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী ওই পর্যন্ত সভাপতির পদটি বাংলাদেশের অধিকারেই থাকার কথা। আইসিসির সভায় পরবর্তী তিন মাসের জন্যও বাংলাদেশের কাউকে সভাপতি রাখার সিদ্ধান্ত হলে তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির এক শীর্ষ কর্তা অবশ্য কাল রাতে মুঠোফোনে বলেছেন, ‘আইসিসির গঠনতন্ত্রে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ না থাকলেও রেজুলেশন অনুযায়ী ৩০ জুন পর্যন্ত সভাপতির পদে বাংলাদেশের কারোরই থাকার কথা। বাংলাদেশ যদি পদ ছেড়ে না দেয়, তাহলে সেখানে অন্য কেউ আসতে পারবে না। তবে পরবর্তী সভায় সেই রেজুলেশনে পরিবর্তনও হতে পারে।’ মুস্তফা কামাল পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালের রাতেই। তবে তাঁর সবকিছুতেই একটু নাটকীয়তা থাকে। কাল যেমন সিদ্ধান্তটা জানানোর আগে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের মতামত নিতে চাইলেন। এরপর পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘এখন যে বক্তব্য দেব সেটা আইসিসির সাবেক সভাপতি হিসেবে।’ আইসিসির গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করে ২৯ মার্চের বিশ্বকাপ ফাইনালের ট্রফি প্রদান করার সুযোগ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে, আইসিসির চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলেই সভাপতির পদ ছেড়েছেন মুস্তফা কামাল। তবে বিমানবন্দর থেকে ই-মেইলে আইসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভ রিচার্ডসন বরাবর পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি সে রকম কিছু উল্লেখ করেননি। সেখানে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ‘ব্যক্তিগত’ কারণে বলে জানানো হয়েছে। দায়িত্ব পালনের সময় কারও মনে আঘাত দিয়ে থাকলে সে জন্য ক্ষমা চেয়ে আইসিসি-সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদও দিয়েছেন তিনি। আশা প্রকাশ করেছেন, আইসিসির নেতৃত্বে ক্রিকেট খেলাটা আরও বেশি করে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। আইসিসি সভাপতির পদ থেকে কামালের পদত্যাগ পদত্যাগপত্রের ভাষা যতটা নরম, সংবাদ সম্মেলনে ততটাই কঠিন ছিলেন মুস্তফা কামাল। কখনো কখনো হয়ে উঠেছেন আবেগপ্রবণও। শ্রীনিবাসন সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘যে মানুষটি বিভিন্নভাবে বিতর্কিত, বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত, আপনারাও জানেন মামলাগুলো কী, এখন সেই মানুষটি যদি ক্রিকেটের দায়িত্বে থাকে, তাহলে ক্রিকেট কীভাবে চলবে, আপনারাই বলুন।’ পরে আরেকবার বলেছেন, ‘আমি পদত্যাগ করেছি কারণ ওই লোকগুলো নোংরা। নোংরা লোকেরা সঠিক মানুষ হতে পারে না। মনের মধ্যে নোংরামি থাকলে তো নোংরা কাজ তারা করবেই।’ তাদের হাত থেকে ক্রিকেটকে বাঁচানোর আহবানও জানিয়েছেন আইসিসির প্রতি, ‘এ ধরনের মানুষকে ক্রিকেট থেকে দূরে রাখা উচিত। নইলে ক্রিকেট ধ্বংস হয়ে যাবে। পুরো ক্রিকেট চলে যাবে দূষিত মানুষদের হাতে।’ শ্রীনিবাসন-কামাল ‘লড়াই’য়ের শুরু ১৯ মার্চ মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনালের পর থেকে। ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমে বাজে আম্পায়ারিংয়ের কড়া সমালোচনা করেন আইসিসি সভাপতি। বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোয় কেন প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হলো না, প্রশ্ন তোলেন তা নিয়েও। মুস্তফা কামালের অভিযোগ শুধু আম্পায়ারিং নিয়েই ছিল না; সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন, ‘মাঠে গিয়ে দেখলাম, স্পাইডার ক্যামেরা নেই। মেলবোর্নের মাঠে এই প্রথম খেলা হলো স্পাইডার ক্যামেরা ছাড়া। খেলা শুরু হওয়ার পর একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আসতে লাগল। জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা দেখলাম, “জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা”। সাথে সাথে আইসিসির সিইওকে বললাম, এটা বন্ধ করুন। তিনি কমার্শিয়াল ম্যানেজারকে বললেন। কিন্তু বন্ধ করা হলো না।’ আইসিসি সভাপতির তেতে ওঠাটা সহজভাবে নিতে পারেননি শ্রীনিবাসন। ফাইনালের আগের রাতে মেলবোর্নে হঠাৎ করেই ডাকেন ‘জরুরি সভা’। সে সভার বর্ণনা দিতে গিয়ে কালই সাবেক হয়ে যাওয়া আইসিসি সভাপতি জানান, তাঁকে প্রথমে আম্পায়ারিং নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেন শ্রীনিবাসন। রাজি না হলে চাপ দেন বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে। মুস্তফা কামাল প্রত্যাখ্যান করেন সে প্রস্তাবও, ‘আমি বলেছি বক্তব্য প্রত্যাহার করব না। সেটি ছিল বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মনের কথা। তাদের বাদ দিয়ে আমি তা প্রত্যাহার করতে পারি না। আমার কাছে আগে দেশ, তারপর আইসিসির সভাপতিত্ব। ১৬ কোটি মানুষকে ছোট করে সভাপতি থাকতে চাই না।’ ‘সত্যি কথা বলা তো অপরাধ নয়’মুস্তফা কামাল মনে করেন, শ্রীনিবাসনের কথা না শোনাতেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর ট্রফি প্রদানের অধিকার। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ট্রফি প্রদানের অধিকার যে তাঁরই ছিল, স্পষ্ট করেছেন সেটাও, ‘গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ৩.৩ (বি) ধারা অনুযায়ী আইসিসির ওয়ার্ল্ড ইভেন্টগুলোতে ট্রফি দেওয়ার দায়িত্ব একমাত্র সভাপতির। সেখানে কোনো রকম বিচ্যুতির সুযোগ নেই।’ সংবাদ সম্মেলনে মুস্তফা কামাল বাংলাদেশের মানুষ, সারা বিশ্বের ক্রিকেটার, সমর্থক, সংগঠক এবং ক্রিকেট পৃষ্ঠপোষকদের উদ্দেশে ইংরেজিতে লেখা একটি বক্তব্য পাঠ করে শোনান। হাতে লেখা সে বক্তব্যে শ্রীনিবাসনের নাম উল্লেখ না করেই বলেছেন, ‘আপনারা জানেন, কিছুক্ষণ আগে আমি আইসিসির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছি। একজন বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই এই সিদ্ধান্ত। তাঁর সততা সব জায়গাতে প্রশ্নবিদ্ধ। গত মাসের ২৯ তারিখে সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং অগঠনতান্ত্রিকভাবে তিনি ২০১৫ বিশ্বকাপের ট্রফি প্রদান করেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আইসিসির বৈশ্বিক ইভেন্টে ট্রফি প্রদান করতে পারেন কেবল সভাপতি। আমি সরে দাঁড়ালাম যেন পুরো বিশ্ব সত্যটা জানতে পারে। সারা বিশ্ব জানুক কীভাবে প্রথমবারের মতো আইসিসির গঠনতন্ত্র অমান্য করা হলো।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিকের সমর্থনের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সভাপতি জগমোহন ডালমিয়াকে ধন্যবাদ দিয়েছেন মুস্তফা কামাল। ধন্যবাদ দিয়েছেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকেও, ‘ওই সময় পাকিস্তান ক্রিকেটও আমাদের সমর্থন করেছে। তাদেরও বিশেষ ধন্যবাদ। আইসিসির সভাপতি নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্যও তাদের ধন্যবাদ।’ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আইসিসির সাবেক সভাপতি শারদ পাওয়ারের প্রতি, আস্থা রেখেছেন আইসিসির ওপরও। আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে থাকার। মুস্তফা কামাল কালই পদত্যাগ করে ফেললেও আইসিসির সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতের এনডিটিভি স্পোর্টসের খবর, বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য আইসিসির নির্বাহী বোর্ড সভাপতির পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিল। আর বিশ্বকাপ ট্রফিটা নাকি শ্রীনিবাসন দিয়েছেন আইসিসির নির্বাহী বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।

No comments:

Post a Comment