Sunday, April 12, 2015

বন্ড সুবিধার অনিয়মে দেশীয় শিল্প ধ্বংসের মুখে:কালের কন্ঠ

শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফারদিন এন্টারপ্রাইজ বন্ড সুবিধায় শুল্ক পরিশোধ না করেই কাঁচামাল আমদানি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছেন বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামালের সবটুকু রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে, খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু চুক্তির সেই শর্ত মানে না প্রতিষ্ঠানটি। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা পণ্যের বড় অংশ তারা খোলাবাজারে
বিক্রি করে থাকে। এ অবস্থায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির ওপর নজরদারি শুরু করে। শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে দেখা যায়, ফারদিন এন্টারপ্রাইজ গত মাসের শেষ সপ্তাহে ৮১ কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বোর্ড ও প্লাস্টিক দানা আমদানি করে। তবে এর মধ্যে ৫০ কোটি টাকার পণ্যই খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এ অনিয়মের ফলে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ১৫ কোটি টাকা। শুধু ফারদিন এন্টারপ্রাইজ নয়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছে এমন ৮৩টি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল আমদানি করে সেগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করছে। শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্ত অনুযায়ী, অনিয়ম করায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকারের পাওনা হয়েছে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৯১ হাজার ৪৫০ টাকা। দুর্নীতি করায় সব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সরকারের পাওনা আদায়ে আইনি প্রক্রিয়ায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্র জানায়, নিবন্ধিত প্রায় ১০ হাজার বন্ডেড ওয়্যারহাউস দেশব্যাপী ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে ঢাকার নিবন্ধিত বন্ডেড ওয়্যারহাউসের সংখ্যা ছয় হাজার ৩০০টি। তার মধ্যে গার্মেন্টস বন্ডের সংখ্যা বেশি। ঢাকায় বর্তমানে সচল বন্ডেড ওয়্যারহাউস রয়েছে তিন হাজার ৮৬৬টি। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সচল বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মধ্যে গার্মেন্টস বন্ড দুই হাজার ৪৯০টি। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ৮৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮টিই গার্মেন্টস বন্ড। ঢাকায় নিবন্ধিত ছয় হাজার ৩০০ বন্ডেড ওয়্যারহাউসের কার্যক্রম তদন্ত করে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত জানুয়ারিতে শুধু গার্মেন্টস বন্ডগুলোয় অনিয়মের কারণে সরকারের পাওনা হয়েছে ৭২৯ কোটি দুই লাখ ৪৯ হাজার টাকা। একই সময় অন্য খাতের বন্ডেড ওয়্যার হাউসে অনিয়ম হয়েছে ৫৪ কোটি তিন লাখ ৯২ হাজার টাকা। ফেব্রুয়ারিতে গার্মেন্টস বন্ডে অনিয়ম হয়েছে ২৫৭ কোটি ৮৭ হাজার টাকা, অন্য খাতের বন্ডে অনিয়ম হয়েছে ছয় কোটি ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। গার্মেন্টস বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে আর্ট বোর্ড বা সিমপ্লেক্স, হার্ড টিস্যু, ডুপ্লেক্স বোর্ড ও সাদা প্রিন্টিং পেপার (কাগজ)। এসব পণ্য মূলত বেশি আসছে ভারত, চীন, কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে। পণ্যগুলো গার্মেস্টস ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদনকারী কারখানায় ব্যবহৃত হবে- এমন শর্তে আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ পুরনো ঢাকার নয়াবাজার, হাশেম টাওয়ারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গার্মেন্টসে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা পণ্যগুলো খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে চুক্তির শর্ত ভেঙে সেগুলো এভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে কাগজ উৎপাদনকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ তারা সব নিয়ম-কানুন মেনে ওই পণ্য উৎপাদন করছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি করা কাঁচামাল কম দামে খোলাবাজারে ছাড়ায় গ্রাহকরা দেশি পণ্য বাদ দিয়ে সেটাই কেনে। বাংলাদেশ পেপার মিলস্ অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ৭১টি পেপার মিল আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে উৎপাদন ক্ষমতা ১২ লাখ টন, আর স্থানীয় বাজারে চাহিদা ১০ লাখ টনের। কাগজ ও কাগজ জাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সিমপ্লেক্স, হার্ড টিস্যু, ডুপ্লেক্স বোর্ড, সাদা প্রিন্টিং পেপার, অফসেট, নিউজপ্রিন্ট, লেখা ও ছাপার কাগজ, সিগারেট ও বিড়ির কাগজ, প্যাকেজিং পেপার, মিডিয়া পেপার, লাইনার, স্টিকার পেপার, বিভিন্ন গ্রেডের টিস্যু পেপারসহ সব ধরনের কাগজের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিতেও সক্ষম। স্থানীয় এই কাগজ শিল্পে প্রায় ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ নির্ভরশীল এ শিল্পের ওপর। দেশীয় কাগজ শিল্পে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। সরকারি কোষাগারেও এ শিল্প থেকে বড় অঙ্কের অর্থ জমা হচ্ছে। দেশীয় কাগজ শিল্পের সঙ্গে দেশের অনেক শিল্প জড়িত। এ শিল্প পরিবেশবান্ধবও। অথচ সম্ভাবনাময় শিল্পটি শুধু বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের কারণে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হতে চলেছে। পুরনো ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দেশে তৈরি ২০০ থেকে ৩৫০ জিএমএমের (গ্রাম/বর্গ ফুট) সিমপ্লেক্সের বিক্রয় মূল্য টনপ্রতি এক লাখ দুই হাজার থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা। অথচ বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা একই পণ্য খোলাবাজারে টনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। দেশে তৈরি ১৬ জিএমএমের হার্ড টিস্যু এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও বন্ড সুবিধায় আনা একই পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। একইভাবে দেশে তৈরি ডুপ্লেক্স বোর্ড টনপ্রতি ৬২ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা বন্ড সুবিধায় আনা একই জাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করছে টনপ্রতি ৫২ থেকে ৫৮ হাজার টাকায়। ৭০ থেকে ১২০ জিএমএমের সাদা প্রিন্টিং পেপার বন্ড সুবিধায় এনে টনপ্রতি বিক্রি করা হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়, আর দেশে তৈরি একই পণ্য বিক্রি হচ্ছে টনপ্রতি ৭৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা বন্ডেড ওয়্যার হাউসের নামে পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে ক্রমাগত লোকসান গুনছেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা বন্ডেড ওয়্যার হাউসের এ অনিয়ম বন্ধের দাবি করছেন। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব নওশেরুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্ড সুবিধায় পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করা বন্ধ না হলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান এভাবে লোকসান গুনে টিকে থাকতে পারবে না। এতে দেশের অর্থনীতি সক্ষমতার পরিবর্তে নির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে যাবে। এ অনিয়ম বন্ধে কঠোর নজরদারির দাবি করেন তিনি। এনবিআর সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সাল থেকে পোশাক খাতে ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) ইস্যুর ক্ষমতা তৈরি পোশাকশিল্পের সংগঠন বিজিএমইকে দেওয়া হয়। এতে করে একটি প্রতিষ্ঠানের কারখানায় ব্যবহারের জন্য কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণ করে বিজিএমই। এ ক্ষেত্রে এনবিআর শুধু ওই গার্মেন্টের ও বন্ডেড ওয়্যার হাউসের অস্তিত্ব আছে কি না বা পণ্য এনে তারা সঠিকভাবে ব্যবহার করছে কি না তা নজরদারি করতে পারে। এর বাইরে একটি সচল বন্ডেড ওয়্যার হাউস কী পরিমাণ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করবে তা নির্ধারণের বিষয়ে এনবিআর আইনি সক্ষমতা নেই। আইনটি পরিবর্তনে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে একাধিকবার সুপারিশ করা হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগ্রতি নেই। একই প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে ও কাস্টমসে ভিন্ন তথ্য দিয়ে, ভুয়া কাগজ পত্র দেখিয়ে, মিথ্যা ঘোষণায় এবং এইচএস কোডে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত পণ্য আনছে। সেগুলো পরে বন্ড সুবিধা পাওয়া কারখানার ও সংশ্লিষ্ট বন্ডেড ওয়্যার হাউসের কর্মীরা এজেন্টের মাধ্যমে দোকানে দোকানে পৌঁছে দিচ্ছে। দেশে তৈরি একই জাতীয় পণ্যের চেয়ে শুল্কমুক্ত পণ্য কম দামে পাওয়ায় বেশির ভাগ দোকানি সেগুলো কিনছে। দোকানিরা পরে সেগুলো খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি করে। বন্ড সুবিধায় অপব্যবহার করে দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কী ধরনের পণ্য আনা হবে এবং তার দাম কত হবে, এ সম্পর্কিত তথ্যে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। যে পণ্য আনার কথা থাকে, আদৌ তা আনা হয় না। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের গত আট মাসে পণ্যের এইচএস কোড, পণ্যের পরিমাণ, ভিন্ন পণ্য এনে মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে এমন চালান চট্টগ্রাম কাস্টমসে পাওয়া গেছে ২৬০টি, মংলা কাস্টম হাউসে পাওয়া গেছে ১৬টি এবং হিলি স্টেশনে পাওয়া গেছে একটি। এসব মামলায় অতিরিক্ত রাজস্ব বাবদ ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আদায় হয়েছে সরকারের। মিথ্যা ঘোষণায় কিভাবে দেশে পণ্য আসছে, এর সঙ্গে কারা জড়িত তা জরুরিভিত্তিতে তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সুপারিশ জানিয়ে গত ৬ এপ্রিল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এনবিআরে চিঠি পাঠিয়েছেন। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বন্ড সুবিধার অনিয়ম বন্ধে এনবিআর ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বন্ডেড ওয়্যার হাউসের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়াতে নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় এনবিআরের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দারা কাজ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে নিবন্ধিত সব বন্ডেড ওয়্যার হাউসের কার্যক্রম তদন্ত করছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ডেড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করছে। শুল্ক গোয়েন্দারা বন্দর থেকে শুরু করে দোকানে-দোকানে গিয়ে তথ্য বের করে দুর্র্নীতিবাজ কারখানা ও বন্ডেড ওয়্যার হাউস চিহ্নিত করছে। দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করা হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। জরিমানা ধার্য করে তা আদায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্ড সুবিধা দেওয়া হয় রপ্তানিমুখী শিল্প গতিশীল করতে। অথচ এসব শিল্পের অনেক ব্যবসায়ী দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। এই দুর্নীতি ঠেকাতে রাজস্ব বোর্ড নজরদারি বাড়িয়েছে। আশা করি দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে।    

No comments:

Post a Comment