Wednesday, April 15, 2015

চলে গেলেন দ্য টিন ড্রামের জনক:কালের কন্ঠ

‘দ্য টিন ড্রাম’ নামের কালজয়ী উপন্যাসের জন্য যিনি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিত, সেই নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস আর নেই। ফুসফুসের অসুখজনিত কারণে গতকাল সোমবার জার্মানির উত্তরাঞ্চলের লুবেক শহরের একটি হাসপাতালে মানবতাবাদী এই লেখকের মৃত্যু হয় বলে তাঁর বইয়ের প্রকাশনী সংস্থা স্টেইডেল জানিয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়ানো গুন্টার গ্রাস ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসি
ক, নাট্যকার,  চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। নিজের সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে মানবতার পক্ষে এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সরব ছিলেন এই লেখক। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালে ১৬ বছর বয়সে অন্য অনেক জার্মান যুবকের মতো বাধ্যতামূলকভাবে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ভাফেন-এসএসে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মনে-প্রাণে ছিলেন নাৎসিবিরোধী। এ তথ্যটি নিজেই ফাঁস করেছেন ২০০৬ সালে প্রকাশিত নিজের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘উইথ স্কিনস অব দ্য বাল্ব’তে। নিজের অনেক লেখায় বিশেষ করে ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস দ্য টিন ড্রামে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নাৎসি বাহিনীর চরম নিষ্ঠুরতার বর্বর ইতিহাস। গ্রাসের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর, পোল্যান্ডের দানজিগে (সাবেক গদানস্ক)। পুরো নাম গুন্টার উইলহেম গ্রাস। বাবা উইলহেম গ্রাস ছিলেন জাতিগত জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট আর মা হেলেন গ্রাস ছিলেন রোমান ক্যাথলিক। শরণার্থী হিসেবে পরিবারের সঙ্গে জার্মানিতে আসেন তিনি। সেই থেকে জার্মানিতে থাকলেও তাঁর লেখায় বরাবরই ঘুরেফিরে এসেছে দানজিগে কাটানো শৈশবের স্মৃতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে মার্কিন সেনাদের হাতে আটক হন গ্রাস। বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শিল্পকলা বিষয়ে পড়াশোনা করেন ডুসেলডর্ফ ও বার্লিনে। প্রথমে শিক্ষা নেন পাথর খোদাই করে ভাস্কর্য গড়ার। ১৯৫৬ সালের দিকে প্যারিস ও বার্লিনে পেশাজীবন শুরু করেন ভাস্কর ও গ্রাফিক আর্টিস্ট হিসেবে। একই সঙ্গে চালিয়ে যান নিজের সাহিত্যচর্চা। ১৯৫৪ সালে বিয়ে করেন আনা মার্গারেট শোওয়ার্তসকে। কিন্তু দুই যুগ পর ভেঙে যায় সংসার। পরে ১৯৭৯ সালে বিয়ে করেন উটে গ্রাসকে। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জনক তিনি। দ্য টিন ড্রামের পর গ্রাস লিখেন ক্যাট অ্যান্ড মাউস (১৯৬১) ও ডগ ইয়ারস (১৯৬৩)। এই তিনটি উপন্যাসকে একত্রে বলা হয় দানজিগ ট্রিলজি। দ্য টিন ড্রামের কাহিনী নিয়ে ১৯৭৯ সালে সিনেমা তৈরি হয়, যা পরে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। এই ট্রিলজিতে তিনি দানজিগের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটভূমির মধ্যে নাৎসিবাদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতার বাস্তব চিত্র অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। ১৯৯৯ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য গ্রাসের নাম ঘোষণা করে সুইডিশ একাডেমির বিবৃতিতে বলা হয়, তিনি তাঁর অসামান্য লেখনীতে ইতিহাসের ভুলে যাওয়া মুখখানি এঁকেছেন। তাঁর লেখা যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি ও ইউরোপের জীবন আলেখ্য। গুন্টার গ্রাসের প্রায় প্রতিটি রচনাই সূক্ষ্মভাবে রাজনীতিনির্ভর। তাঁর মতে, মানবিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের মীমাংসায় সামনের সারিতে থাকা একজন লেখকের দায়িত্ব। সাম্রাজ্যবাদ আর ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধেও সরব ছিলেন তিনি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর তীব্র সমালোচক ছিলেন গ্রাস। তিনি মনে করতেন, বুশ এই যুদ্ধের নামে ধর্মকে ব্যবহার করছেন। ইসরায়েলের সমালোচনা করে ২০১২ সালে ‘হোয়াট মাস্ট বি সেইড’ নামের একটি গদ্য-কবিতা লেখেন। ইসরায়েল তখন তাঁর বিরুদ্ধে অ্যান্টি-সেমিটিজমের (ইহুদিবাদবিদ্বেষী) অভিযোগ এনে তাঁকে ইসরায়েলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ জন্য নিজের দেশেও তাঁকে বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছিল। চওড়া কাঁধ আর ঝোলা গোঁফের এই লেখকের ১১টি উপন্যাস ও অনেকগুলো নাটক, কবিতা ও প্রবন্ধের বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে দানজিগ ট্রিলজি ছাড়াও দ্য ফ্লাউন্ডার (১৯৭৩), দ্য র‌্যাট (১৯৮৬), শো ইয়োর টাং (১৯৮৬), টু স্টেটস ওয়ান নেশন (১৯৯০), ক্র্যাব ওয়াক (২০০২), দ্য বক্স (২০০৮) উল্লেখযোগ্য। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও অনেক পুরস্কার, সম্মাননা ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গ্রুপ ৪৭ প্রাইজ (১৯৫৮), ক্রিটিকস প্রাইজ (জার্মানি, ১৯৬০), ফরেন বুক প্রাইজ (ফ্রান্স, ১৯৬২), বুহনার প্রাইজ (১৯৬৫), ফনটেন প্রাইজ (১৯৬৮), মাজাকোস্কি মেডেল (১৯৭৭), লিওনার্দ ফ্রাঙ্ক রিং (১৯৮৮) ইত্যাদি। তিনি ১৯৭৬ সাল থেকে এল ম্যাগাজিনের কো-এডিটর এবং ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বার্লিন একাডেমি অব আর্টসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৬ সালের ৩ ডিসেম্বর স্ত্রী উটে গ্রাসকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন গুন্টার গ্রাস। প্রথম দিনই তাঁরা গিয়েছিলেন পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার। দেখেছেন শাঁখারিদের জীবনযাপন। এরপর ঘুরে বেড়িয়েছেন মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্প, বাংলাবাজার, ইসলামপুর ও আহসান মঞ্জিল। খাওয়াদাওয়া করেছেন সদরঘাটের ভাসমান হোটেলে। ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে জমিয়েছেন তুমুল আড্ডা। জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে মাতিয়েছেন কবিতা পাঠের আসর। তাঁতিদের কাজ দেখতে এক ফাঁকে গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের বাজিতপুর। এ ছাড়া গিয়েছিলেন প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে। সেখানকার লোকশিল্প জাদুঘর দেখার পাশাপাশি ঘুরে বেড়িয়েছেন পানাম নগরও। গ্রাসের এই সফরে সব সময় সঙ্গী হিসেবে ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী আর আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সূত্র : বিবিসি, এএফপি, ডয়েচেভেলে, অনলাইন।

No comments:

Post a Comment