Wednesday, April 15, 2015

স্বস্তির উৎসবে রঙিন দেশ:কালের কন্ঠ

ফসলি সন নামে বাংলা বর্ষ গণনা চালু হয়েছিল কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে। এটি চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে। এখন মোগল সম্রাটরাও নেই, চৈত্র মাসের শেষ দিনে খাজনা আদায়ও হয় না; কিন্তু বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষের প্রথম দিন উদ্‌যাপন এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উৎসব। সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণের দিক দিয়ে প্রধান উৎসব এটি। তবে ব্যবসায়ীদের মতে, পোশাক কেনাবেচার দিক দিয়ে বাংলা বর্ষবরণ এখন দ্বিত
ীয় বড় উৎসব। বাংলা বর্ষবরণ উদ্‌যাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো, তবে বড় উৎসব হয়ে ওঠার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। আকবরের সময় প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাসুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন খাইয়ে আপ্যায়ন করতেন। আয়োজন করা হতো মেলাসহ বিভিন্ন উৎসবের। কিন্তু এখন রাজধানীর রমনা বটমূলে গান গেয়ে নতুন বছর বরণ করা হয়। চারুকলা থেকে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। নতুন রঙিন পোশাক পরে বাঙালি শামিল হয় সে উৎসবে। সকালে ঘরে ঘরে চলে পান্তা-ইলিশ খাওয়া। দুপুরে ভালো রান্না হয়। আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণও করা হয়। মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছাবিনিময়ের চল অতি সাম্প্রতিক। অন্য সব উৎসব থেকে বাংলা বর্ষবরণ উৎসবের পার্থক্য ধরা পড়ে রঙিন পোশাক, সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ ও আলাদা কিছু রীতির মধ্যে। দিন যত যাচ্ছে বর্ষবরণ উৎসব আরো জমকালো হচ্ছে, বাড়ছে মানুষের অংশগ্রহণ। দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়ছে। পহেলা বৈশাখ ঘিরে বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা গড়ে উঠছে। এতে গতি পাচ্ছে অর্থনীতিও। বৈশাখের রং লাল ও সাদা- এটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গত এক দশকে। এখনকার বৈশাখী পোশাকে এ রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। বুটিক হাউসগুলো বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন পোশাক তৈরি করে, বিশেষ করে শাড়ি ও পাঞ্জাবি। গত এক দশকে একটু একটু করে এসব পোশাকের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় পাঁচ হাজার ফ্যাশন হাউস। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার পোশাকের বাজার তৈরি হয়েছে। দেশি পোশাকের ব্র্যান্ডগুলোর সংগঠন ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজহারুল হক আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোতে সারা বছর যে পোশাক বিক্রি হয় তার ২৫ শতাংশ বিক্রি হয় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে। বাজারের আকার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাকের বাজার বাড়ায় দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোর বাইরে অন্যান্য পোশাকের ব্র্যান্ডও তাদের শোরুমে বৈশাখী পোশাক তুলতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি ফুটপাতেও বৈশাখী পোশাকের বাজার জমছে। আজহারুল হক আজাদ বলেন, এখন সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে পহেলা বৈশাখে নতুন পোশাক পরার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ফলে পোশাকের বাজারও বড় হয়েছে। পোশাকের ব্র্যান্ড নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান বলেন, আগে পোশাকের দুটি মৌসুম ছিল। এখন পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর- এ উৎসবগুলো যোগ হয়েছে। এসবের মধ্যে পোশাক বিক্রির দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। এর পরই পহেলা বৈশাখ। শুধু পোশাকের বাজার নয়, বৈশাখের আমেজ লাগছে কাঁচাবাজারেও। ইলিশের দাম দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা প্রতিবছরের। এবার বেড়েছে মাংসের দামও। এমনকি ভর্তা খাওয়ার কুঁচে চিংড়ির কেজি ৪৪০ টাকায় উঠেছে পহেলা বৈশাখের কারণে। বেগুন ভর্তা খাওয়ার জন্য বেগুনের চাহিদাও বাড়তি। বিক্রি বেড়েছে সুগন্ধি চাল, মসলা, ঘি-দুধ, পানীয়, মিষ্টি ও মৌসুমি ফলের। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জানান, পহেলা বৈশাখে তাঁদের কম্পানির পানীয় ও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভোগ বাড়ে। এর কারণ বাড়িতে বাড়িতে ভালো রান্না ও মানুষের ঘোরাঘুরি বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম বলেন, 'পহেলা বৈশাখ এখন ঈদ উৎসবের মতো হয়ে গেছে। এ সময় মাংসের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এবার গরুর সরবরাহ কম থাকায় অনেক দোকানেই মাংস পাওয়া যায়নি।' বিভাগীয় ও জেলা শহরে এখন ঘটা করেই বর্ষবরণ করা হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে ঐতিহাসিক মেলাও বসে। সম্প্রতি নানা ধরনের মেলার চল হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। শহুরে শ্রেণির বাইরে গ্রামেও পহেলা বৈশাখে ঘরে ভালো রান্না করা এখন বিরল ঘটনা নয়। অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের মতে, মানুষের মধ্যে সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রকাশের আগ্রহ থেকে সর্বজনীন এ উৎসব পালন করার রীতি ছড়িয়ে পড়ছে। এটা যত ছড়িয়ে পড়ে ততই ভালো। তিনি বলেন, 'এখন এ উৎসব গ্রামেও পালিত হচ্ছে। এটা আমাদের সবার এক হওয়ার দিন।' এবার বিক্রিতে লক্ষ্যপূরণ হয়নি : বৈশাখী আয়োজনে দেশীয় ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকানগুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করলেও প্রত্যাশামতো বিক্রি হয়নি তাদের। তিন মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর তাদের বিক্রি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু শেষ তিন-চার দিনে কিছুটা ভাটা পড়েছে কামারুজ্জামানের ফাঁসি ঘিরে। ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজহারুল হক আজাদ বলেন, এবার শুরুর দিকে বিক্রি বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর ও হরতাল নিয়ে আতঙ্কের কারণে ক্রেতারা কম বেরিয়েছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর মৌচাক, মালিবাগ, বেইলি রোডে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেও একই কথা জানা গেছে। এসব এলাকার বড় শপিং মল ইস্টার্ন প্লাস, কনকর্ড টুইন টাওয়ার ও নাভানা শপিং মলে প্রতিবছর উৎসবের আগের দিন যে হারে ভিড় থাকত, এ বছর তেমনটি নেই। কে ক্রাফটের বেইলি রোড শাখার ব্যবস্থাপক আব্দুল কাইয়ুম মিয়া বলেন, 'ক্রেতা আছে ঠিকই, কিন্তু বিক্রি ভালো নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বাচ্চাদের পরীক্ষার ব্যস্ততার জন্য এখন অনেকেই বের হতে পারছেন না।' বাংলার মেলার শোরুম ব্যবস্থাপক হেমায়েত হোসেন বলেন, 'প্রতিবছরই চাহিদা বাড়ছে। সে হিসেবে আমরাও পোশাক তৈরি করেছি প্রায় দ্বিগুণ। ফলে গত বছরের চেয়ে বেশি বিক্রি হলেও প্রয়োজনীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়।' বছর ঘুরে আজ সেই পহেলা বৈশাখ, ১৪২২ বঙ্গাব্দ। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের বর্ণিল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের দিন। আজ নতুন সূর্যের আলোকচ্ছটায় রাঙা হবে গোটা দেশ, নেচে উঠবে মানুষের মন। ঘর ছেড়ে রাস্তায় প্রাঙ্গণে নামবে মানুষ, মেতে উঠবে প্রাণের উৎসবে।

No comments:

Post a Comment