তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আটঘাট বেঁধে নেমেছে আওয়ামী লীগ। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে নানা কৌশল প্রয়োগ করছে দলটি। অন্যদিকে প্রার্থী নির্বাচনে এলোমেলো ও অগোছালো অবস্থা বিএনপির। ফলে বিএনপি প্রার্থীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের প্রতিটি স্তরেই দলের সিদ্ধান্ত এসেছে কেন্দ্র থেকে, কোনো নেতা-কর্মী সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি বা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেননি। অ
ন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বেই কেটেছে প্রথম এক সপ্তাহ। আর প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে প্রার্থী মনোনয়নে সংকটে পড়েছে দলটি। দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে নির্বাচনের পথে এসে দলটির অবস্থা অনেকটাই পথহারা। চট্টগ্রামে আগের মেয়র মনজুর আলমকে প্রার্থী করে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে পারলেও ঢাকার দুই সিটিতে অবস্থা মোটেও ভালো নয়। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থা দলটির নেই। বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, সিটি নির্বাচনে বিএনপির কৌশল কী হবে, তা-ও এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। বিএনপি প্রার্থী ঠিক করতে দেরি করায় ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’ দুই সিটিতে প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচারে নামতে পারছে না। ঢাকা সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত বিএনপিপন্থী বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের এ সংগঠনটি চেয়েছিল সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘটা করে প্রার্থী ঘোষণা করতে। কিন্তু গতকাল রাত ১০টায় অগোছালো অবস্থার মধ্যে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করতে হয়েছে। ১৩ এপ্রিল বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের পরিচিতি সভায় খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ঠিক করা। এসব প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর একক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। বিশেষ করে দক্ষিণে সাঈদ খোকন ও উত্তরে আনিসুল হককে গণভবনে ডেকে নিয়ে নির্বাচনে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা তখন আড়ালে-আবডালে বলার চেষ্টা করেন, তাঁদের সঙ্গে একটু আলোচনা করলে কী হতো? এর জবাবে সরকারের একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মহানগর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রার্থী ঠিক করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এতে দলের মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব আরও বাড়ত। অন্যদিকে চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মেয়র যেভাবে চুপসে গেলেন, তাতে দলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই বিস্মিত। দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সেখানেও প্রার্থী হিসেবে আ জ ম নাছিরকে চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে দলের একক ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি আ জ ম নাছিরের পক্ষে কাজ করার প্রকাশ্য অঙ্গীকার করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ঢাকায় দুই মেয়র প্রার্থী মনোনীত করার পরও সৃষ্ট সংকটের সমাধানে নেপথ্যে ভূমিকা রাখেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যাংকঋণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় সাঈদ খোকনকে রক্ষা এবং দলের প্রতিপক্ষ হাজি মো. সেলিমকে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া থেকে বিরত রাখার নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো হয়। মনোনয়ন ফরম জমা না দিয়ে হাজি সেলিমের বিদেশে যাওয়া, বিদেশ থেকে ফিরে সাঈদ খোকনের সঙ্গে হাসিমুখে তাঁর কাজ করার অঙ্গীকার, সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করার আবেদন জমা দিলেও তা গ্রহণ না করাসহ বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে দক্ষিণে একক প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান সাঈদ খোকন। পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের পুত্র, সুবক্তা এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে যাওয়া ওই নেতা এখন পর্যন্ত প্রচার ও গণসংযোগে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাস ৪০টি মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। ৩৭টি মামলায় জামিন পেলেও তিনটি মামলায় জামিন পাননি। সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ বলে মনে করছেন তাঁর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পলাতক থেকেই মনোনয়ন ফরম তোলা, জমা দেওয়ার কাজ সেরেছেন। স্ত্রী আফরোজা আব্বাস তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। দক্ষিণে সরকারি দলের বিরোধ দৃশ্যত মিটে গেলেও সেখানে বিএনপির বিরোধ রয়েই গেছে। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে মির্জা আব্বাসের বিরোধ এখনো মেটেনি। খোকা বিদেশে অবস্থান করলেও তাঁর সমর্থক ও নেতা-কর্মীরা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে নেই। এ ছাড়া বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় তিনিও বৈধ প্রার্থী হিসেবে আছেন। ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বিএনপি উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তিন সপ্তাহ সময় নিয়েছে। দক্ষিণে মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিল হয়ে গেছে, সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েও প্রার্থিতা ফিরে পাননি তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তাবিথ আউয়ালকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। বিএনপির নেতারা বলছেন, মিন্টুর জন্য বিএনপিকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে আট দিন। ১ এপ্রিল বাছাইয়ে মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হওয়ার পর ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত কাল চূড়ান্তভাবে বাদ পড়েন মিন্টু। তাঁর ছেলে তাবিথ আউয়ালের মনোনয়নও ঝুঁকিতে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাবিথ টিকে যান। কিন্তু এই আটদিনে বিএনপির নজর ছিল আদালতের দিকে। কিন্তু উত্তরে সরকারি দল আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থী আনিসুল হক অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে বলার পর থেকে তিনি পুরোমাত্রায় কাজ করছেন। সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরী উত্তরের মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও গতকাল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এ প্রসঙ্গে কবরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চাইছেন না, দলের একাধিক প্রার্থী মেয়র পদে থাকুক। এতে দলে বিশৃঙ্খলা হবে। উনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে সরাসরি কিছু বলেননি। তবে মনে হয়েছে, উনি (প্রধানমন্ত্রী) চান, আমি নির্বাচন না করি। তাই ওনার (প্রধানমন্ত্রী) প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি প্রত্যাহার করলাম।’ সারাহ বেগম মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় সেখানে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় প্রার্থী রইল না। আওয়ামী লীগ-সমর্থক একক প্রার্থী রইলেন আনিসুল হক। ব্যবসায়ী এই নেতাকে নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন থাকলেও তা নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সবাই নীরবে মেনে নিয়েছেন। দলীয় সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটিতে একক কাউন্সিলর প্রার্থী দিতে দুটি কমিটি করেছিল বিএনপি। উত্তরে দলের যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লা, দক্ষিণে ঢাকা মহানগরীর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসকে কমিটির প্রধান করা হয়। তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রত্যেক ওয়ার্ডে যোগ্যতা বিবেচনায় দুজনের নাম প্রস্তাব করতে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই কমিটি প্রার্থী বাছাই করতে সময় নিয়েছে বেশি। মঙ্গলবার দুই কমিটি তালিকা জমা দিয়েছে। গতকাল বিএনপির চেয়াপারসনের গুলশানের বাসায় তালিকা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত একক কাউন্সিলর প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেনি দলটি। তবে আজ একটা সুরাহা হবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। কাউন্সিলর পদে প্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। দলটি ঢাকার ১৫টি সংসদীয় আসনের জন্য ১৫টি কমিটি করে দিয়েছে। ওই সব কমিটিতে স্থানীয় সংসদ ছাড়াও দলের শীর্ষ নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই কমিটি নির্বাচন করতে আগ্রহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের ফরমে আগাম সই নেয়। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের একদিন আগে বুধবার আওয়ামী লীগ ৯৩টি কাউন্সিলর পদের মধ্যে ৯১টিতে একক প্রার্থী ঘোষণা করে। দুটি ওয়ার্ডে বিএনপি-সমর্থক প্রার্থী না থাকায় উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অথচ একেকটি ওয়ার্ডে সরকারি দলের ৫ থেকে ১২ জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম তুলেছিলেন। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এভাবে প্রার্থীদের বসিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, এর ফলে দলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলা হলেও ভোটারদের অসম্মান করা হয়।
No comments:
Post a Comment