Tuesday, April 7, 2015

ফাঁসি যে কোনো দিন:যুগান্তর

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউয়ের) আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এতে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকল না। সোমবার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ রিভিউ খারিজ আদেশ দেন। সামান্য কয়েক সেকেন্ডে ‘ডিসমিসড’ শব্দটি উল্লেখের মধ্য দিয়ে বিচার প্রক্র
িয়া শেষ হয় প্রায় ৬২ বছর বয়সী এ যুদ্ধাপরাধীর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন তার ফাঁসি কার্যকর করার পালা। যে কোনো দিন এ ফাঁসি কার্যকর হবে। তবে এর আগে বাকি রয়েছে কিছু আনুষ্ঠানিকতা। এর মধ্যে রিভিউ খারিজ সংক্রান্ত রায়ে বিচারপতিরা স্বাক্ষরের পর তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাতে হবে। এরপর কামারুজ্জামানকে রিভিউ আবেদন খারিজের তথ্য জানানো হবে। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা কারা কর্তৃপক্ষ সেটি জানতে চাইবে। প্রাণভিক্ষার আবেদন জানানোর ইচ্ছে প্রকাশ করলে তাকে একটা যুক্তিসঙ্গত সময় দেয়া হবে। এরপর আবেদনটি রাষ্ট্রপতি নিষ্পত্তি করবেন। তারপর যে সাজা বহাল থাকে সেটা কার্যকর হবে। এছাড়া তার পরিবারের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হবে। সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত রিভিউ খারিজ সংক্রান্ত রায়ের কপি কারাগারে পৌঁছায়নি। তবে কারা কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে সোমবার সন্ধ্যায় কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাত পৌনে ৮টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী কারা ফটকে আসেন। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখনও পর্যন্ত রিভিউ আবেদন খারিজ আদেশের কপি হাতে পাইনি। এজন্য আজ (সোমবার) রাতে ফাঁসির রায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর তা কামারুজ্জামানকে জানানো হবে। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করবেন কিনা সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। আদালতের আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর তাকে পড়ে শোনানো হবে। এরপর তিনি প্রাণভিক্ষা করলে সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করলে আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। একইভাবে তিনি প্রাণভিক্ষা না করলে কারা কর্তৃপক্ষ রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেবে। প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের সবসময়ই প্রস্তুতি থাকে। রিভিউ খারিজের পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘রিভিউ আবেদন খারিজের মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের বিচার কার্যক্রমের পরিসমাপ্তি ঘটল। এখন দুটি বিষয় বাকি আছে। একটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতির কাছে উনি প্রাণ ভিক্ষা চাইবেন কিনা এবং দ্বিতীয়ত, আপনজনের সঙ্গে উনার দেখা করা। তার পরের বিষয় হল, দণ্ড কার্যকর করা। সেটা কখন কার্যকর হবে তা সরকার নির্ধারণ করবে বলে জানান তিনি।’ এর আগে সকালে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে যত দ্রুত সম্ভব জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার জন্য ২-৩ ঘণ্টা সময় পাবেন কামারুজ্জামান। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে যে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে এ সময়টুকু তাকে দেয়া হবে।’ অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘প্রাণভিক্ষার আবেদন নিষ্পত্তির জন্য আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেয়া হয়নি। আসামি কখন প্রাণভিক্ষা চাইবেন- সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো বিধান নেই। এর আগে কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশন খারিজের রায়ে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার জন্য ‘যৌক্তিক সময়’ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে, ৭ দিন বা ১৫ দিন সময় পাবে। জেল কর্তৃপক্ষ এটা তাকে (কামারুজ্জামানকে) জানাবে, জানানোর পর একটি সময় প্রদান করা। সেটা বিবেচনা করবে জেল কর্তৃপক্ষ।’ আর কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে রাষ্ট্রপতি তার নিষ্পত্তি করবেন উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, উনি বিবেচনা করবেন, রাষ্ট্রপতির কাছে সেই ফাইল ৭ দিনও থাকতে পারে আবার ১৫ দিনও থাকতে পারে। আবার রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, উনি বিবেচনা করবেন না। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ঘণ্টার ভেতরে ফেরত পাঠাতে পারেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর হবে না।’ এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও কাদের মোল্লার মামলায় রিভিউ খারিজের দিনই দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি তুলে ধরে একজন সাংবাদিক এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি জানতে চান, কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রেও তেমনটি হচ্ছে কিনা। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কাদের মোল্লা প্রাণভিক্ষা চাননি। এ সুযোগের বিষয়টি তাকে জানানো হলেও তিনি আবেদন করেননি। আর তার আত্মীয়-স্বজনরাও আগে তার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন। সুতরাং তার ব্যাপারে সব রীতি-নীতি মেনেই দণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এখানে কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে এখনও দুটি বিষয় বাকি আছে। অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কখন দণ্ড কার্যকর হবে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হল, তার দণ্ড বহাল আছে। কার্যকরের দিন সরকার নির্ধারণ করবে।’ অন্য ফাঁসির রায়ের মতো এ যুদ্ধাপরাধ মামলার ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। রিভিউ খারিজের রায় কিভাবে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাবে- এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপিল বিভাগ থেকে ট্রাইব্যুনালকে বিষয়টি জানানো হবে। ট্রাইব্যুনাল কারা কর্তৃপক্ষকে জানাবে। সুপ্রিমকোর্ট সরাসরিও কারা কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন।’ এদিকে সোমবার রাতে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘রিভিউ খারিজের স্বাক্ষরিত আদেশের কোনো কপি এখনও হাতে পাইনি।’ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায় : ২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত উল্লেখ করে এ রায় দেয়া হয়। এর মধ্যে দুটিতে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন। আপিলের শুনানি শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল রাখেন। বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। আপিল বিভাগের রায়ে কামারুজ্জামানকে এক নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আনা একাত্তরে বদিউজ্জামানকে হত্যার ঘটনা সংবলিত এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছিলেন। ২ নম্বর অভিযোগ যথা- শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় তাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এই সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগ বহাল রাখেন। তার বিরুদ্ধে তিন নম্বর অভিযোগটি ছিল সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে গণহত্যা ও ধর্ষণের। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১৪৪ জন ব্যক্তিকে হত্যা এবং বহু নারীকে ধর্ষণের দায়ে একাত্তরে ময়মনসিংহের আলবদর নেতা কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। এ অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার ব্যাপারে বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী একমত পোষণ করেন। আর বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদানের পক্ষে রায় দিয়েছেন। চতুর্থ অভিযোগ গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন করেন। সপ্তম অভিযোগে দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের আনা পাঁচ ও ছয় নম্বর অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালই তাকে খালাস দেন। রিভিউ দায়ের ও শুনানি : ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পরদিন ট্রাইব্যুনাল-২ তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠালে সেখানে কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ৫ মার্চ আবেদন করেন কামারুজ্জামান। ৫ এপ্রিল এ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। সকাল ৯টা ৫ মিনিটে আপিল বিভাগের চার বিচারপতি এজলাসে আসার পর প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা শুধু ‘ডিসমিসড’ (খারিজ) শব্দটি উচ্চারণ করেন। তিন মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি : কামারুজ্জামানের মামলার বিচারের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে তিনটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল। এর আগে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দিলেও আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এছাড়া দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর কার্যকর হয়।  

No comments:

Post a Comment