Tuesday, April 28, 2015

ব্যালটে রাজনীতির লড়াই:প্রথম অালো

ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আগ্রহের পাশাপাশি শঙ্কাও আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও জাতীয় রাজনীতি এতে প্রভাব ফেলেছে। পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক রূপ পেয়েছে এই নির্বাচন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের আন্দোলন চলাকালে সহিংস ঘটনাগুলোর ছেদ ফেলতে আজকের এই নির্বাচন ভূমিকা রেখেছিল। সার্বিক পরিস্থিতিতে এই নির্বাচনই আবার নতুনভাবে রাজনৈতিক উত্তাপ
ছড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। আজকের ভোটের পর রাজনীতির মাঠ কেমন হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। দেশ আবারও ৫ জানুয়ারি-পরবর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে পারে কিনা, সেই আশঙ্কার কথাও বলাবলি হচ্ছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দাবি, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। আর সরকারি দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতা ও প্রার্থীরা নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপি-সমর্থিত নাগরিক সংগঠন আদর্শ ঢাকা আন্দোলন এক বিবৃতিতে বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে অভিযোগ করেছে, ঢাকা দক্ষিণের চারটি কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সই নেওয়া হয়েছে। বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকার চেষ্টা করবেন দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। তবে সরকারের কাছে এই নির্বাচন ‘জিতলেও সমালোচনা, হারলেও সমালোচনা’—এমন একটি মূল্যায়নে বাধা পড়েছে। এ প্রসঙ্গে সরকারের একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিতলে বলা হবে জোর করে জিতেছে। হারলে বলা হবে জনপ্রিয়তা নেই বলেই হেরেছে। রসিকতা করে ওই মন্ত্রী বলেন, তার চেয়ে বিজয়ী হয়েই সমালোচিত হওয়া ভালো। সরকারদলীয় একাধিক সূত্র জানায়, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে বা আন্দোলনের মাঠ থেকে সরাসরি নির্বাচনে আসতে পারবে, এমন ধারণা ছিল না। কিন্তু প্রথমে ধীরগতিতে এগোলেও পরে উত্তরে বিএনপির মূল প্রার্থীর বিকল্প ও দক্ষিণে মূল প্রার্থীর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী নির্বাচনের মাঠে নামলে সাড়া পড়ে। সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীদের ভাবমূর্তির সংকট তেমন নেই এবং নির্বাচনের মাঠে তাঁরা এগিয়ে ছিলেন। তার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় বিএনপির বিকল্প প্রার্থীরাই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। তফসিল ঘোষণার পর ভোটারদের অংশগ্রহণ ভালো হবে বলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মত দেন। তবে তাঁরাই এখন বলছেন, ভোটারদের মধ্যে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, তার অনেকটাই উবে গেছে নির্বাচনপূর্ব কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে। গত বছরের ৫ জানুয়ারি একতরফা জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশের মতো ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশির ভাগ ভোটারই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। আর ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিলের পর ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনই হয়নি। ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিলেও এই নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সায় ছিল না। তখন আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে নির্বাচন আটকে দেওয়া হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় গত প্রায় ১৩ বছরে ঢাকা শহরের নাগরিক সেবা তলানিতে পৌঁছেছে। জনপ্রতিনিধি না থাকা, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ভেঙে প্রশাসক দিয়ে পরিচালনা করাসহ নানা কারণে নগরবাসী বিরক্ত। এ ছাড়া অধিকাংশ ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া, শহর অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়া, নিম্নমানের রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতা, আর মশার উপদ্রবে রাজধানী ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক সংকট এবং নাশকতার মধ্যে তিন সিটির নির্বাচনের ঘোষণায় নগরজীবনে স্বস্তি নেমে আসে। নগরবাসী নির্বাচনকে মন্দের ভালো হিসেবে গ্রহণ করে। গত ১৮ মার্চ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ভোটারদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা যায়। কিন্তু গত কয়েক দিনের নির্বাচনকেন্দ্রিক উত্তেজনায় এক ধরনের উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলের প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ পাননি বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েক দিনে বিরোধী প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। তাঁরা যাতে ভোট দিতে কেন্দ্রে না যান, এ জন্য পরিকল্পিতভাবে ভয় দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, কাকে ভোট দেব, কেন ভোট দেব, ভোট দিয়ে কী লাভ, ভোটের সঠিক মূল্যায়ন হবে কি না, এমন সব প্রশ্নে জর্জরিত সাধারণ ভোটার। এই সংখ্যা ৩০ শতাংশের বেশি বলে ধারণা করা যায়। এঁদের অনেকেই নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে ছুটি কাটাতে পারেন। কিন্তু এঁদের কেন্দ্রে নেওয়ার দায়িত্ব সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রার্থীদের। ভোটারদের এই অনীহার পেছনে একটি বড় কারণ ভীতি ছড়ানো। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯ কোটি ৬২ লাখ ভোটারের মধ্যে আজ তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দেবেন ৬০ লাখ ৩৩ হাজার ১২৫ জন। ঢাকা উত্তরে ভোটার প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ, দক্ষিণে ১৮ লাখ ৭০ হাজার এবং চট্টগ্রামে ১৮ লাখ ১৩ হাজার। চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ১৭ জুন। আজ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে বেশি আলোচনায় আছেন ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক এবং বিএনপি–সমর্থিত তাবিথ আউয়াল, ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি–সমর্থিত মির্জা আব্বাস ও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত সাঈদ খোকন। আর চট্টগ্রামে রয়েছেন বিএনপি সমর্থিত মোহাম্মদ মনজুর আলম ও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আ জ ম নাছির উদ্দিন। আজকের নির্বাচনে তিন সিটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭৮ হাজার ৭৩০ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। ঢাকা উত্তরে ৩০ হাজার ৭৬৪, দক্ষিণে ২৬ হাজার ৪৯৬ এবং চট্টগ্রামে ২১ হাজার ৪৭০ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তিন সিটিতে তিন ব্যাটালিয়ন (এক ব্যাটালিয়ন ৭৪১) সেনাসদস্য থাকবেন। তবে তাঁরা মাঠে নয়, সেনানিবাসেই অবস্থান করবেন। প্রয়োজনে ডাক পড়লেই সেনানিবাসের বাইরে যাবেন। একাধিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক দিনের বেশ কয়েকটি ঘটনায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাঁরা নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, সরকার-সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীদের অবস্থান, সরকারদলীয় সাংসদদের দিয়ে কমিটি গঠন, বিরোধী দল-সমর্থক প্রার্থীদের বাড়িয়ে প্রচার, সেনা মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বিমুখী অবস্থান, বিক্ষিপ্ত হামলা ও ভাঙচুর এবং পুলিশের গ্রেপ্তার বা হয়রানির ঘটনাগুলোর কথাই বলছেন ঘুরেফিরে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার ওপর তিন দফা হামলার পর নির্বাচন মাঠের চিত্র বদলাতে শুরু করে। তবে আওয়ামী লীগ-সমর্থক সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, নির্বাচনের আগে যেসব উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, সেগুলো মিথ্যা প্রমাণ করবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে যেসব অপতৎপরতা হয়েছে তার বিপরীতে দুই বড় শহরের রুচিশীল নাগরিকেরা ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেবেন। বিএনপি-সমর্থক শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। তাঁর মতে, কমিটির পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যেসব দাবি করা হয়েছিল, তার একটিও নির্বাচন কমিশন মেনে নেয়নি। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ভোটাররা নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন ও অন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে বা শৈথিল্য প্রদর্শন করা হলে তা বরদাশত করা হবে না। এদিকে বেসরকারি ২৮টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক মো. আবদুল আলীম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনপূর্ব পর্যবেক্ষণে তাঁরা ভোটারদের মধ্যে সংশয় দেখেছেন। বিশেষ করে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে বা ভোট দিতে পারবেন কি না, এটা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। আর এ কারণেই ভোটার উপস্থিতি কমতে পারে এবং অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কাও থাকছে। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে ভোট কারচুপির সম্ভাবনা তুলনামূলক কম। প্রত্যেক কেন্দ্রে মেয়র সমর্থক ছাড়াও থাকবেন একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্ট বা সমর্থকেরা। দলের বিদ্রোহী ও বিরোধী কাউন্সিলর প্রার্থীরাও টাকা খরচ করেছেন এই নির্বাচনের জন্য। তাই কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হবেন না। এই পরিস্থিতির মধ্যে শুধু মেয়র প্রার্থীকে বের করে আনা সহজ নয়। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সিটি নির্বাচনকে দুই নেত্রী জাতীয় নির্বাচনের মতো অবস্থায় নিয়ে গেছেন। দলীয় মনোনয়ন, দলীয় সমর্থন, পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন এবং বিএনপির নেত্রী ও কয়েকজন প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনাগুলো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও অসন্তোষ ছড়িয়েছে।

No comments:

Post a Comment