‘মেড ইন জিনজিরা’র কথা কে না জানে। অন্তত বাংলাদেশের সবারই জানা। এটি আর কোথাও নয়, রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে যান্ত্রিক এ শিল্পনগরী ‘জিনজিরা’। প্রায় সব ধরনের মোটর পার্টস ও যন্ত্রপাতি তৈরিতে বিখ্যাত এখানকার হাজারও কারখানা। এ জিনজিরার দিকে তাকালে শিল্প ও প্রযুক্তিতে উন্নত এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠবে। বলতে ইচ্ছে করবে ‘মেড ইন জিনজিরা’ বাংলাদেশের অহংকারও বটে।
latinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=acd94d5f' target='_blank'> দেশের গৌরবময় এ এলাকাটি কেরানীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষা জিনজিরা-শুভাঢ্যা থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হাজারের কাছাকাছি কারখানা। অবিরাম ইঞ্জিনের ধপাধপ ও গড়গড় শব্দ। কারিগরের হাঁকডাক, শ্রমিকদের কোলাহল এখানে রাত-দিনের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে। প্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শী না হয়েও শুধু নিজের মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক জ্ঞান-বুদ্ধি ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার কারিগর বিস্ময়করভাবে তৈরি করে চলেছে আধুনিক সব খুচরা যন্ত্রপাতি। শুধু চোখের দেখায় তারা প্রস্তুত করছেন চীন ও জাপান মডেলের অনেক কিছু। যাদের ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে সুই, ব্লেড, আলপিন থেকে শুরু করে নাট-বল্টু, ফ্লাস্ক ও মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ। এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজ, রেল ও বিমানের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে এখানে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। মেড ইন বাংলাদেশ না লিখলে সাধারণ চোখে কারো বোঝার উপায় নেই যে, এটি বাংলাদেশের তৈরি। জিনজিরার কারিগররা বিভিন্ন মেশিন, মেশিনের খুচরা পার্টস, বিশেষ করে মোটর পার্টস অবিকল তৈরি করে দিতে পারে- এমন সুনাম রয়েছে অনেক আগে থেকেই। এছাড়া হার্ডওয়ার যন্ত্রাংশ তৈরিতে এখানকার কারিগর ও শ্রমিকরা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প উন্নত দেশের সঙ্গে শুধু প্রতিযোগিতা নয়, নাম্বার ওয়ানে উঠে আসতে পারবে। এখানকার কারখানা মালিক ও বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা বিপুল পরিমাণ বিদেশী যন্ত্রাংশের আমদানি ব্যয় কমাতে সক্ষম হবেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, ‘জিনজিরা বিপ্লব’ বাংলাদেশকে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরিতে সক্ষমতার পাশাপাশি বিরাট সাফল্য এনে দিয়েছে। এ নীরব বিপ্লবের নায়কদের পুঁথিগত জ্ঞানের অভাব থাকলেও কারিগরি জ্ঞানের মোটেই অভাব নেই। তারা তাদের সে জ্ঞান দিয়ে উৎপাদন করছেন নানা ধরনের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ। কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে এসব কারিগরের চিন্তা ও হাতের ছোঁয়ায়। তাদের সাফল্যে এখন চীন ও ভারতের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশী যন্ত্রপাতি বিদেশে রফতানিও হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কেরানীগঞ্জ ও জিনজিরার পণ্য। একইসঙ্গে স্থানীয় বাজারে ‘মেড ইন জিনজিরা’র পণ্যের চাহিদা ও কদর ক্রমেই বাড়ছে। দামে সস্তার পাশাপাশি মানের দিক থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে এখানকার যন্ত্রপাতি। এসব কারণে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছে। জানা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ‘জিনজিরা’ নিজেকে একটি প্রযুক্তিপাড়া হিসেবে আবিষ্কার করলেও এখন তার যশখ্যাতি দেশ থেকে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। আর জিনজিরাকে বেশি সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে এখানকার তাওয়াপট্টি। কেননা তাওয়াপট্টি হল অবিকল ডিজাইনের যে কোনো যন্ত্রপাতি তৈরি করে দেয়ার মহাওস্তাদ। এখানে টিনের ঘরের ছোট ছোট কারখানায় তৈরি হচ্ছে দেশী-বিদেশী মডেলের নানা যন্ত্রপাতি। যার মানও ভালো। এমন মন্তব্য কয়েকজন ক্রেতার। তারা বলেন, যারা বলে জিনজিরার পণ্য নকল তারা আসলে বোকা। কেননা, এখন আর আগের জিনজিরা নেই। এখানে এখন উন্নত মানের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। যার দামও সাধ্যের মধ্যে এবং টেকশই তো বটেই। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এখানে তৈরি হচ্ছে নাট-বল্টু, ওয়াশার, স্প্রিং, দরজার কব্জা, ছিটকিনি, বার্নার, ক্লাম, টোপ ওয়াশার, প্লেনজার, কলের বাকেট, হ্যাশবল তালা, শাটার স্প্রিং, স্ক্রু, রিপিটসহ সব ধরনের হার্ডওয়্যার সামগ্রী, গাড়ির পার্টস, তারকাঁটা, জিআই তার, আলতালা, হ্যাসবোল্ট, কব্জা, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ডেকোরেটর সরঞ্জাম, ওয়াশিং টব, পিতলের বার্নার, কেরোসিন চুলা, পিতলের ডেগ, তামার ডেগ, ক্রোকারিজ, তাওয়া, টিফিন ক্যারিয়ার, সাইলেন্সার, আশকল ডুম্বরি, নিক্তিকাঁটা, সাঁটার, লোহার জানালা, দরজা, অ্যালুমিনিয়ামের জগ-মগ। নিত্যপ্রয়োজনীয় ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব মালামাল তৈরি করছেন লেখাপড়া না জানা একদল ‘ইঞ্জিনিয়ার’। কেউ কিছুটা জানলেও অনেকের শিক্ষা প্রাইমারির গণ্ডি পার হয়নি। এখানকার ক্ষুদে কারিগরদের দক্ষতা অবাক করে দেয়ার মতো। বছরের পর বছর গবেষণার পর জাপান, কোরিয়া ও চীন যেসব সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করছে সে পণ্য জিনজিরার ইঞ্জিনিয়াররা একবার দেখলেই কেল্লাফতে। কিছুদিনের মধ্যে হুবুহু সে পণ্য জিনজিরা থেকে বাজারে চলে আসে। জাহাজভাঙা স্ক্র্যাপ, বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, রোলিং মিল, নির্মাণাধীন স্থাপনার পরিত্যক্ত লোহা ও শিট থেকে অবাক করা নানা যন্ত্রপাতিও তৈরি করছেন তারা। এ প্রসঙ্গে তাওয়াপট্টির কারখানা মালিক বাবু বলেন, ’ভাই- আমরা তো গবেষণা করি না। বিদেশে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে করে নতুন নতুন যন্ত্র বা মেশিন আবিষ্কার করেন। আমাদের কাছে আসলেই সেটা দেখে অবিকল আরেকটা তৈরি করে দিই। তিনি বলেন, এতে খরচ যেমন কম হয় তেমনি মেরামতে সুবিধাও বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় অর্থনীতিতে কেরানীগঞ্জের এ নীরব শিল্প বিপ্লব যে অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকায় ছোট-বড় এক হাজারের বেশি কারখানা থাকলেও দেশজুড়ে একই আদলের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ৪০ হাজারেরও বেশি। দেশব্যাপী এখন এ ধরনের অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে যারা কারিগর হিসেবে কাজ করছেন তাদের হাতেখড়ি এ জিনজিরাতেই। জিনজিরার প্রতিটি অলিগলিতে জীবন সংগ্রামী মানুষের অজস্র সাফল্যচিত্র চোখে পড়ে। ক্ষুদ্র কারখানাগুলোয় বেঁচে থাকার অবলম্বন থেকেই একেকজন উঠে গেছেন শীর্ষ পর্যায়ে। স্থানীয় শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম জানান, আশপাশের ১০ গ্রামের সম্পূর্ণ অদক্ষ প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে জিনজিরায়। তাওয়াপট্টি, টিনপট্টি, আগানগর, বাঁশপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকায় বিস্তৃতি ঘটেছে হাজারও ক্ষুদ্র্র ও হালকা শিল্প-কারখানার। ফ্লাস্ক থেকে মোবাইল ফোনসেটের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত সবকিছুই তৈরি হচ্ছে নিয়মিত। বিখ্যাত সব কোম্পানির মালামাল তৈরি করছে লেখাপড়া না জানা এ কারিগররা। এদের স্থানীয়ভাবে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ নামেই ডাকা হয়। জাফরুলের ভাষায়, সব ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্য অভাবনীয়। এ প্রসঙ্গে তাওয়াপট্টি ক্ষুদ্র্র ও কুটির শিল্প মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. জুয়েল যুগান্তরকে বলেন, সরকারী সহযোগিতা পেলে দ্রুত এখানকার লৌহজাত কুটির শিল্পের আরও বিকাশ হতে পারে। উদ্যোক্তাদের প্রধান সমস্যা অর্থ সংকট। বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। অথচ স্বল্পসুদে টাকা পাওয়া গেলে সারা দেশের চাহিদামতো লৌহজাত পণ্য এখান থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হতো। অথচ বিকশিত এসব শিল্প অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচিয়ে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। জিনজিরার এ ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা ও মেধাবী কারিগররা অর্ধ শতাব্দীতেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও কষ্ট রয়েছে। সরকারি সহায়তাও জোটেনি তাদের ভাগ্যে। উল্টো বিভিন্ন সময় ‘নকলবাজির’ অভিযোগ তুলে নানা কায়দায় তাদের হয়রানি করা হয়। থানাঘাট এলাকার বাসিন্দা আরজু মিয়া বলেন, জিনজিরা শিল্প-কারখানাকে অনেকে ‘নকলবাজ’ বললেও আমরা এগুলোকে আশীর্বাদই মনে করি। এত প্রশাসনিক হয়রানি, পুলিশ-ডিবির অভিযান সত্ত্বেও আমরা এখান থেকে কারখানাগুলোকে হটিয়ে দিইনি। তাদের আশ্রয় দিই, কাজ চালিয়ে যাওয়ার সাহস দিই। ভাই ভাই মেটাল ওয়ার্কার্সের শ্রমিক শিল্পী ও মুন্নি বলেন, ভালো মজুরি পাই বলে নিয়মিত কাজে আসি।
No comments:
Post a Comment