কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের পাশের পাহাড়ি বনভূমিতে 'রাতারাতি' গড়ে উঠেছে কিছু রহস্যময় স্থাপনা। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪০টি সেমিপাকা ঘর, মসজিদ ও হাসপাতাল। সব মিলিয়ে রীতিমতো একটি কমপ্লেক্স। কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে এই কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছে তা এখনো জানা যায়নি। গহিন পাহাড়ি এলাকায় এত নির্মাণসামগ্রী এনে বন বিভাগসহ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে কিভাবে এতগুলো অব
ৈধ স্থাপনা তৈরি হয়ে গেল তাও কেউ বলতে পারছে না। তবে জানা গেছে, নির্মাণকাজ চলছে সশস্ত্র পাহারায়। বিষয়টি নিয়ে রহস্যের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক পর্যায়ে তোলপাড় পড়ে গেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, এটা কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর কাজ। কমপ্লেক্সের আড়ালে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির বানানোই তাদের উদ্দেশ্য। আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে মধ্য এশিয়াভিত্তিক কোনো কোনো এনজিও, যাদের নামে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে অবহিত করেছে। জানা গেছে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ঘুনধুম পয়েন্ট থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে মাছকারিয়া বনভূমিতে গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে এসব স্থাপনা। এই কমপ্লেক্সের অদূরেই রয়েছে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত দুটি আশ্রয়শিবির। আশপাশের এলাকাবাসীরও অভিযোগ, জঙ্গি অর্থায়নেই সরকারি বনভূমি দখল করে এসব 'রহস্যময় অবকাঠামো' গড়ে তোলা হয়েছে। এলাকায় বলাবলি হচ্ছে, কমপক্ষে পাঁচ-ছয় কোটি টাকার গোপন প্রকল্প নীরবেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর তাও সশস্ত্র পাহারায় এ নির্মাণকাজ করা হচ্ছে বলে বন বিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে। একটি সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে, রহস্যঘেরা এ কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজে জড়িত আছেন উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির শ্যালক, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম গতকাল এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার ইউনিয়নের দুই তৃতীয়াংশ এলাকাই বনভূমি। তাই বনভূমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। মাছকারিয়া এলাকার মাত্র কয়েক একর বনভূমিতে নতুন যে ঘরগুলো হচ্ছে এগুলো সবই ভূমিহীনদের। আমরা তাদের সহযোগিতা করছি।' ভূমিহীনদের এ রকম সেমিপাকা ঘর নির্মাণের টাকার উৎস কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তাদের সমিতি রয়েছে এবং টাকা-পয়সাও আছে।' এই কমপ্লেক্সের পেছনে বিদেশি এনজিও এবং জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং আপনার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে ওই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, 'আমার পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক শত্রু রয়েছে। তাই অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারেন।' খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া সদর বনবিটের আওতাধীন মাছকারিয়া বনভূমির কমপক্ষে ১০ একর জমি দখলে নিয়ে এসব রহস্যঘেরা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এলাকাটিতে দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানইজেশনের (আরএসও) লোকজনের যাতায়াত রয়েছে। আরএসওর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়াভিত্তিক এনজিওর ছদ্মাবরণে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের। কুতুপালং গ্রামের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, আনরেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শিবিরের রোহিঙ্গাদের মধুরছড়া এবং মাছকারিয়া বনভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও শোনা গেছে। এখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর তাদের নেওয়া হয় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কুলাচি, দুছড়ি এবং মিয়ানমার সীমান্তবর্তী আরএসওর সামরিক ট্রেনিং ক্যাম্পে। কুতুপালং আনরেজিস্টার্ড ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের নামে বিদেশি লোকজনের আসা-যাওয়া প্রায়ই রয়েছে এই এলাকায়। কুতুপালং গ্রামের লোকজন জানে, এসব ঘরবাড়িতে রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি সাহায্য-সামগ্রী মজুদ করে রাখা হবে। আবার অনেকেই বলছেন, এখানেই রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। সরকারি বনভূমি দখলে নিয়ে রহস্যময় স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল সরকার গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বন বিভাগের জমি দখল করে অল্প কদিনের মধ্যেই এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আমার অধীনস্থ বন কর্মীরা ঘটনাস্থলের কাছে গেলেও এই অবকাঠামো নির্মাণকাজে জড়িতদের সশস্ত্র পাহারার কারণে একদম কাছে যেতে পারেননি।' তিনি বলেন, 'এখানকার অত্যন্ত উদ্বেগজনক কথা আমি শুনেছি। স্পর্শকাতর বিষয়টি আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বনভূমি দখলের ঘটনায় স্থানীয় বিট কর্মকর্তা মোজাম্মেল হককে সাময়িক বহিষ্কারের সুপারিশ করেছি।' এ সব বিষয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি এবং উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি পাঁচ-ছয় দিন আগে জেনেছি বনভূমিতে আকস্মিকভাবে কে বা কারা স্থাপনা নির্মাণ করছে। শুনেছি বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের লোকজন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার আড়ালে থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য এসব অবকাঠামো নির্মাণ করছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় আমি আমার দলীয় সিনিয়র পর্যায়ে জানিয়েছি। তবে এসব নির্মাণের নেপথ্যে কে বা কারা জড়িত, তা আমি জানি না।' কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে আহমদ হোসেন গতকাল এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ কে তো সীমান্ত এলাকা। এর ওপর রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় সরকারের কাউকে না জানিয়ে এ রকম পাকা অবকাঠামো নির্মাণের ঘটনায় আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমি ঘটনার কথা শুনেই জেলা প্রশাসকের নজরে নিয়েছি। জেলা প্রশাসক নিজেই বলেছেন, তিনিও শুনেছেন বিষয়টি। এটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে।' কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন বন বিভাগের জমি জবরদখল করে এতগুলো সেমিপাকা ঘর নির্মাণের ঘটনা অবশ্যই উদ্বেগজনক। কে বা কারা এটা করেছে, এসব বিষয়ও দেখা হবে। আমরা এ বিষয়টিকে সিরিয়াসলি দেখব। বিষয়টি আমাকে বন বিভাগীয় কর্মকর্তা আজই (শনিবার) জানিয়েছেন। তবে এখানে আমার প্রশ্ন, বন বিভাগের এই জমি কি এক দিনেই দখলে নেওয়া হয়েছে আর এসব স্থাপনা কি এক দিনেই নির্মাণ করা হয়েছে?' কক্সবাজারের উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) হাবিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, 'কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের কথা শুনেছি। এসব স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এবং উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। আমি ও ওসি সাহেব কাল-পরশু ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাব।' ব্যাপারটি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তোলপাড় হলেও উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিল্লোল বিশ্বাস এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। গতকাল বিকেলে ইউএনওর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'এসব বিষয়ে আমি জানি না। আপনি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখুন।' কক্সবাজারে কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁরা এ স্পর্শকাতর বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করেছেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমশিনারের (আরআরআরসি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে জাতিসংঘের চারটি সংস্থা- এইএনএইচসিআর, ডাব্লিউএফপি, ইউএনএফপিএ, আইওএম এবং স্থানীয় সাতটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কাজ করছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো হলো বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট (বিডিআরসিএস), টিএআই (টাই), আরটিএমআই, ভার্ক, হ্যান্ডিক্যাম্প ইন্টারন্যাশনাল, আরআইবি (রিভ) এবং সেভ দ্য চিলড্রেন। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক তিনটি বেসরকারি সংস্থা যথাক্রমে এমএসএফ (মেডিসিন সেন্স ফ্রন্টিয়ার্স), মুসলিম এইড এবং এসিএফ (অ্যাকশন কন্ট্রোল ফন্টেলা) সরকার ২০১২ সালে রোহিঙ্গা শিবিরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও এত দিন ধরে এনজিওগুলো সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই কাজ করেছে। তবে সম্প্রতি এসিএফ এবং এমএসএফ সরকারের কাছ থেকে আরো দুই বছর রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করার অনুমতি নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ মুজাহিদ উদ্দিন জানান, মুসলিম এইডের টেকনাফ সদর অফিস সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে সীমিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সরকার মুসলিম এইডকে ২০১২ সালে নিষিদ্ধ করেছিল; তা এখনো বহাল রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসাসহ শিবিরের অভ্যন্তরে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্যও দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম এইডসহ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আরো কিছু এনজিও পরিচয়ধারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা কর্মীদের এসব অভিযোগে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি কিছু লোক মুসলিম এইডে কর্মরত থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতাদের নিয়ে সৌদি আরব ও তুরস্কের কিছু এনজিওর লোকজন প্রায়ই রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক ঘটনায় লিপ্ত থাকে। এসব বিষয়ে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সাবেক নেতা হাফেজ সালাউল ইসলাম গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মোটেই সত্য নয়। আমরা জঙ্গিবাদে জড়িত নই।'
No comments:
Post a Comment