ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী কফিল উদ্দিন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করে বলেছেন, কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবল তাঁকে নির্বাচনী কাজে বাধা দিচ্ছেন। ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল বিভিন্ন সময়ে পুলিশ এসে হুমকি দিয়ে গেছে। এতে তাঁর নির্বাচনী প্রচার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কফিল উদ্দিনের মতো এমন অভিযোগ আরও অনেক প্রার্থীর। তাঁরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ বেছে বেছে বিএনপি-সমর্থিত
কাউন্সিলর প্রার্থীদের হয়রানি করছে ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি সরকারি দলের লোকেরাও নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য তাঁদের চাপ দিচ্ছেন। এমনকি নির্বাচনী প্রচার বন্ধ না করলে বাড়িছাড়া করা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। পুলিশ সেটাই করছে। নির্বাচনে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ কমিশনার গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটার বা বাসিন্দা নন, এমন ব্যক্তিদের ঢাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাঁরা শহরে অবস্থান করছেন, তাঁদেরও শহর ত্যাগ করতে হবে। এ সময় বাইরে থেকে আসা লোকজনকে রাজধানীতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ওই কর্মকর্তা জানান, কমিশনারের এ নির্দেশের পর গত শনিবার রাত থেকে পুলিশ বহিরাগত ব্যক্তিদের ধরার নামে রাজধানীতে অভিযান শুরু করেছে। তবে অভিযানের লক্ষ্যই হচ্ছে বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থক। অবশ্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হলেও গ্রেপ্তারের সংখ্যা নেই বললেই চলে। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে আড়াই শ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেখানে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখা থেকে মাত্র তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করা হয়েছে। রাজধানীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড, ওয়ারী, লারমিনি স্ট্রিট, র্যাংকিন স্ট্রিট এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শনিবার রাত থেকে গতকাল সারা দিন বিএনপি-সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং তাঁদের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ তল্লাশি করেছে। পুলিশের ভয়ে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, শনিবার রাত থেকে দফায় দফায় তাঁর এবং তাঁর সমর্থকদের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তাঁদের বাড়ির লোকদের আগামী পাঁচ দিন বাড়িতে থাকতে নিষেধ করা হয়েছে। একই ওয়ার্ডের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী রাশেদ রেজাকে গতকাল পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এ এলাকার বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিল প্রার্থী লিয়াকত আলী পলাতক। তাঁর বাড়িতেও পুলিশি তল্লাশি করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আবুল কাশেম মোল্লা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর লোকজন ও শাহ আলী থানার পুলিশ তাঁকে নির্বাচনী কাজে বাধা দিচ্ছে। পুলিশ কর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে গ্রেপ্তারের ভয় দেখাচ্ছে। এ নিয়ে কাশেম মোল্লা ২১ এপ্রিল রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে শাহ আলী থানার উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়। জানতে চাইলে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, ‘সে (কাশেম মোল্লা) অভিযোগে কী কারণে শাহ আলী থানার নাম দিয়েছে বলতে পারব না। তবে হুমকি দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ সিদ্ধেশ্বরী, রমনা, কাকরাইল এলাকা নিয়ে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। এখানকার বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জুয়েল তাঁর দলের নেতা ও প্রচারকর্মীদের ফোন করে প্রচারণা বন্ধ রাখতে বলেছেন। প্রচার বন্ধ না করলে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছেন। জানতে চাইলে উপপরিদর্শক জুয়েল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, আরিফুল ইসলামের সঙ্গে দেখা ও কথা হয়নি। ওই এলাকাতেও তিনি যাননি। তাঁর দাবি, দেশ টিভির গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামি আরিফুল। এ মামলার তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা। সেই ক্ষোভ থেকে তিনি এ অভিযোগ করতে পারেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড, লালবাগ কিল্লা মোড়, শহীদ নগর, আমলিগোলা এলাকার বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী সফিউদ্দিন আহমেদের (সেন্টু) বোন সায়েরা বেগম গতকাল প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রায় ২০ জন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাঁদের লালবাগের বাড়িতে আসেন। তাঁরা বিভিন্ন ঘরে তল্লাশি চালান এবং সেন্টু কোথায় আছেন জানাতে বাড়ির লোকদের ওপর চাপ দেন। সায়েরা বেগম জানান, এটি তাঁদের পৈতৃক বাড়ি। এখানে তাঁরা ভাইবোন মিলে থাকেন। সেন্টুর নামে ২০টির মতো মামলা রয়েছে, তিনি পলাতক। ভাইয়ের পক্ষে তিনি এবং অন্য ভাই-ভাতিজা-ভাগনেরা প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, পুলিশ ঘর থেকে ভোটের প্রচারপত্রগুলো নিয়ে গেছে। এ সময় তাঁদের বাড়িতে কামরাঙ্গীরচর থেকে তাঁর এক খালাতো বোন বেড়াতে এসেছিলেন। পুলিশ তাঁকে রাতেই কামরাঙ্গীরচরে ফিরে যেতে বাধ্য করে এবং জানিয়ে দেয়, এ বাড়িতে কোনো আত্মীয়স্বজন আসা চলবে না। ৫২ নম্বর ওয়ার্ড, মুরাদপুর এলাকার বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী বাদল রানার অভিযোগ, গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত চার দফায় তাঁর উত্তর মুরাদপুরের বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুটি মামলা। তিনি আত্মগোপন করে আছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল তাঁর চার প্রচারকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১১ নম্বর ওয়ার্ডের শাজাহানপুর, উত্তর শাজাহানপুর, শহীদবাগ, রেলওয়ে কলোনি এলাকার বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেনের অভিযোগ, গতকাল শহীদবাগে তাঁর প্রচারকর্মীদের পুলিশ বাধা দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে প্রচারপত্র কেড়ে নেয়। জানতে চাইলে শাহজাহানপুর ওসি মেহেদী হাসান বলেন, এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি। চামেলীবাগ, শান্তিনগর এলাকা নিয়ে ১৩ নম্বর ওয়ার্ড। এখানকার বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী লোকমান হোসেন ফকির অভিযোগ করেন, আমিরুল ইসলাম নামে তাঁর এক নির্বাচনী এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে এখন কেউ এজেন্ট হতে চাইছেন না। পল্টন থানার ওসি মোরশেদ আলম অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো ও তাঁদের বাড়ি তল্লাশির নামে হয়রানির ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব অভিযোগ আসে, সেগুলো রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয় নিষ্পত্তির জন্য। তাঁরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশকে নির্দেশ দেবেন। তিনি বলেন, ‘এমন কিছু অভিযোগ আমিও পর্যালোচনা করেছি। যেগুলো সুনির্দিষ্ট নেই। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে কারও বিরুদ্ধে পরোয়ানা থাকলে পুলিশ যদি তাঁকে তাড়া করে, সেখানে আমাদের কিছু করার নেই।’ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের ভূমিকা হওয়া উচিত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করবে পুলিশ। কীভাবে রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে, সেটা পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে পুলিশ যদি কাজ করে, তাহলে তাতে মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। সাধারণ মানুষ তখন পুলিশকে তাঁর প্রতিপক্ষ মনে করবে।
No comments:
Post a Comment