Wednesday, April 29, 2015

'সবই তো দেখছেন কী আর বলব':কালের কন্ঠ

দুপুর সাড়ে ১২টা। বন্দরটিলা এলাকার কাটাখালী আলীশাহ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি ভোটকেন্দ্রের (৬৭১ ও ৬৭২) ভেতরটা ফাঁকা। কেন্দ্রের বাইরে অর্ধশতাধিক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানায়, এলাকার ভোটাররা সকাল সকাল ভোট দিয়ে চলে গেছে। কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে জানা গেল অন্য ঘটনা। ৬৭২ নম্বর ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম পুলিশ প্রহরায় নিজ কক্ষে বসে আছেন। গণমা
ধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, 'সবই তো দেখছেন, কী আর বলব। অল্পের জন্য প্রাণ রক্ষা পেয়েছে।' কী ঘটনা ঘটেছে? জানতে চাইলে এই প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, 'দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় ছেলেরা দল বেঁধে এসে আমার পোলিং অফিসারদের কাছ থেকে জোর করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তারপর হাতি প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে দিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় সিলগুলো নিয়ে গেছে। সিলের অভাবে এখন আমি ভোট পরিচালনা করতে পারছি না। বিষয়টি ওপরের মহলে জানানো হয়েছে।' বন্দরটিলা এলাকাটি নগরের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে। এই এলাকার কাটাখালী আলীশাহ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি কেন্দ্রের মধ্যে অন্যটি হলো ৬৭১ নম্বর। এ ভোটকেন্দ্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, 'আমার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রটি স্কুলের চতুর্থ তলায় হওয়াতে আমি নিরাপদে ছিলাম। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় হামলা হয়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছি।' গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়েছে। নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন। তাঁর প্রতীক হাতি। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলমের প্রতীক কমলালেবু। ভোটগ্রহণের চিত্র সরেজমিনে গিয়ে দেখার জন্য নগরির ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে পরিদর্শনে যান কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদক। ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৭১ ও ৬৭২ নম্বর ভোটকেন্দ্র কাটাখালী আলীশাহ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই ভোটকেন্দ্রে মোট ১২ হাজার ভোটার রয়েছে। কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়ানো লোকজন জানায়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সকাল ১০টার মধ্যেই এলাকার অধিকাংশ ভোটার ভোট দিয়ে চলে গেছেন। পরে অবশ্য কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে এবং দুই প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলে আসল চিত্রটি পাওয়া গেছে। এরপর দুপুর ১টার দিকে ওই ওয়ার্ডের নৌবাহিনী আবাসিক এলাকার পূর্ব পাশে দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত ৬৬২ নম্বর মহিলা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় কেন্দ্রটি দখল করার চেষ্টা করছে ফটকের বাইরে অবস্থান নেওয়া শতাধিক পুরুষ। এ সময় কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের পরিদর্শক মো. বেলালের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এলাকাবাসী বারবার কেন্দ্রের ভেতর প্রবেশের চেষ্টা করছে। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে গেছে। এই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা তিন হাজার ৪২০ জন। কেন্দ্রের ২ নম্বর বুথে ৩৩৯ জন ভোট দেওয়ার কথা। কিন্তু দুপুর ১টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ৩৭টি। এসব কর্মকর্তা আরো বলেন, 'এখন কেন্দ্রে কোনো মহিলা ভোটার না থাকায় বাইরের পুরুষরা কেন্দ্রে প্রবেশ করে অবৈধভাবে ভোট দিতে চাপ সৃষ্টি করছে। তাই আমরা নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য ওপরের কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি।' খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারীদের জন্য স্থাপিত কেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করা এসব পুরুষ নাছিরের সমর্থক। নগরীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের পতেঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয়ে সকাল ১০টা থেকে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রের প্রধান ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা বলেন, সকালে গণ্ডগোল হয়েছিল। এরপর থেকে ভোটগ্রহণ বন্ধ। দুপুর দেড়টায় এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'দুই হাজার ৭১৮ জন ভোটার রয়েছে এই কেন্দ্রে। কেন্দ্রের বিভিন্ন বুথে সকালে ৮০০ ব্যালট ইস্যু করা হয়েছিল। সকাল ১০টার দিকে বহিরাগত লোকজন এসে সব ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখি।' এ সময় কেন্দ্র থেকে বের হয়ে দেখা যায়, র‌্যাব সদস্যরা ফটকের বাইরে অবস্থানরতদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এসে আবার ভোটগ্রহণ শুরু করার জন্য বলে যান। দুপুর ২টায় নগরীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের লালদিয়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭১৮ নম্বর ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো ভোটার নেই। কেন্দ্রের বাইরে বেশ কয়েকজন লোক বসে আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটাররা সকালে ভোট দিয়ে চলে গেছে। পরে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মঈন উদ্দিন জানান, এই কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ৫৯৫ জন। দুপুর ২টা পর্যন্ত ৪০ শতাংশ ভোট গ্রহণ হয়েছে। এখন কেন্দ্রে কোনো ভোটার নেই। ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ এনে মনজুর দুপুরের আগে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন। সে কারণে ভোটগ্রহণের চিত্রও পাল্টে যায়। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ৭১৯টি ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯ জন। ভোটগ্রহণের হার গড়ে ৩০-৪০ শতাংশ। গতকাল সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোটগ্রহণের আগে দেখা গেছে, কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের লাইন। সকাল সোয়া ১১টায় বিএনপি সমর্থিত এম মনজুর আলম নির্বাচন বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার পর তাৎক্ষণিক তা ছড়িয়ে পড়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। মনজুর নির্বাচন বর্জনের পর শুরু হয় বিভিন্ন কেন্দ্রে 'ফ্রি স্টাইলে' প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নাছিরের হাতি প্রতীকে সিল মারা। বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে এ দৃশ্য দেখা গেছে। কয়েকটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখের সামনে অবাধে সিল মারা হচ্ছে। সকাল সাড়ে ৭টায় ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ৪০ জন পুরুষ ভোটার ভোট দেওয়ার জন্য মাঠে সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘড়ির কাঁটা সকাল ৮টায় ভোট শুরু হয়। তখন পর্যন্ত সারিতে শতাধিক পুরুষ ভোটার দাঁড়িয়ে গেছেন। সকাল ৮টা ৫২ মিনিটে এই কেন্দ্রে ভোট দেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত নাগরিক কমিটির মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন। ৮টায় ভোট শুরুর পর কেন্দ্রের বুথ ঘুরে দেখা গেছে সব বুথেই বিএনপি সমর্থিত মনজুর আলমের কমলালেবু প্রতীকসহ বিভিন্ন প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দায়িত্ব পালন করছেন। সকাল সোয়া ১১টায় মনজুর আলমের নির্বাচন বর্জনের পর বাকলিয়ার তিনটি (১৭, ১৮ ও ১৯) ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, মনজুর আলমের পোলিং এজেন্টরা বেরিয়ে আসছেন, আর নাছিরের অনুসারী নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করছে। তাদের মুখে মুখে শোনা যায়, 'মনজুর আলম (কমলালেবু) সরে গেছেন তাঁকে আপনারা কেন ভোট দেবেন। তিনি পরাজয় আঁচ করতে পেরে নির্বাচন বর্জন করেছেন। আপনারা হাতি প্রতীকে ভোট দেন। এলাকার উন্নয়ন হবে।' এরপর দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে দেখা যায় দ্বিতীয় তলায় পুরুষের বুথগুলোতে (ভোটকক্ষ) সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারদের সামনে ১২ থেকে ১৫ জন যুবক প্রকাশ্যে ব্যালট পেপার নিয়ে মেয়র প্রার্থীর হাতি প্রতীক ও কাউন্সিলর প্রার্থীর ঘুড়ি প্রতীকে সিল মারছে। দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ওই কেন্দ্রে অবস্থানকালে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেন্দ্রে মোট ভোটার দুই হাজার ৩৪৫ জন। এর মধ্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩০০ ভোট পড়ে। এরপর এক ঘণ্টায় আরো ৭০০ ভোট পড়েছে। এ ব্যাপারে প্রিসাইডিং অফিসার গাজী গোলাম মওলা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আপনারা তো দেখছেন ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩৯২টি ভোট কাস্ট হয়েছে।' প্রকাশ্যে সিল মারার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দৌড়ে ওই কক্ষগুলোতে ছুটে যান। এক পর্যায়ে পুলিশ ও ভোটগ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বহিরাগতদের বের করে দেন।    

No comments:

Post a Comment