Monday, April 27, 2015

নগদ লাভের আশায় অনেক বস্তিবাসী:প্রথম অালো

নগরের ভোট। নাগরিকদের নানান হিসাব-নিকাশ চলছে। তবে বস্তিবাসীদের কাছে নগদ লাভালাভের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এ জন্য ভোট গ্রহণ যত এগিয়ে আসছে, টাকা ছড়ানো ও টাকা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা—দুটিই প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিন ঢাকার বড় পাঁচটি বস্তিতে ঘুরেছেন প্রথম আলোর তিনজন প্রতিবেদক। ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে, তাঁরা মেয়র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে নগদ আর্থিক সুবিধাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে কাউন্সিলরদ
ের বেলায় ‘কাছের মানুষ’ খোঁজার প্রবণতা রয়েছে। আর এবারের নির্বাচনে টাকাপয়সা ছড়ানো হতে পারে মোবাইলের ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশের মাধ্যমে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বস্তিবাসীদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছে। এটি এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। বস্তিগুলোতে গিয়ে ধারণা পাওয়া গেছে, বাসিন্দাদের মাত্র অর্ধেক সিটি এলাকার ভোটার। সে হিসাবে দুই সিটিতে বস্তিবাসী ভোটার প্রায় সাড়ে তিন লাখ। উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীন বনানীর কড়াইল ও মহাখালীর সাততলা বস্তি, কল্যাণপুর পোড়া বস্তি, মিরপুরের বাগানবাড়ি ও সোবহান রোড বস্তিতেই ভোটার প্রায় ৫০ হাজার। এর মধ্যে কড়াইল বস্তিতেই প্রায় ২৬ হাজার ভোটার। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতিদিনই এসব বস্তিতে প্রচারণা চলাচ্ছেন। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনকে বস্তিবাসীরা বিনোদনের অংশ মনে করে। এ জন্য তাদের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে টাকা আর পেশিশক্তির কারণে বস্তিবাসীরা সঠিক প্রার্থী নির্বাচন করতে পারে না। এবার নির্বাচনে প্রার্থীদের বেশির ভাগই টাকাওয়ালা-ব্যবসায়ী। তাই অর্থ ছড়ানোর প্রবণতাও বাড়বে। কল্যাণপুর পোড়া বস্তি: শুক্রবার বেলা ১১টা। ইট-সুরকি-কাদামাটির পথ ধরে এগিয়ে যেতেই দেখা যায় বাসিন্দাদের বেশির ভাগই রাস্তায়-দোকানে বসে গল্প করছেন। এমনই একটা চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল জয়নাল আবেদীন পাটোয়ারীর সঙ্গে। পেশা বলতে ধরাবাঁধা কিছু নেই। চার সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে এই বস্তিতে বসবাস। জয়নাল বলেন, ‘ভোট আইলে অনেক ভদ্রলোক কাদামাখা শরীরেই জড়াই ধরে। পরে আর দেহা পাই না। কমিশনারদের তাও ধরা যায়। এমপি আর মেয়র হইলে লাভ কী?’ সেখানে একে একে ভিড় করেন আজহার, আবদুল মোতালেব, গোলাম রব্বানী। জমে ওঠে নির্বাচনী আলোচনা। আশপাশে জড়ো হন আরও ৮-১০ জন। তবে তাঁরা বক্তা নন, শ্রোতা। সরবদের বেশির ভাগ সরাসরি জানালেন, তাঁরা সরকারি দল-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীকে ভোট দেবেন। তবে কাউন্সিলরদের বেলায় দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ, সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থীর চেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীকে বেশি আপন মনে করেন তাঁরা। সরকারের পক্ষ থেকে বস্তি ভাঙতে এলে তাঁকে পাশে পাওয়া যায়। আলাপে জানা গেল, কল্যাণপুরে ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থানে ১০টি বস্তি। ভোটার প্রায় সাত হাজার। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই ভোলার নদীভাঙনের শিকার। ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরেরও আছেন অনেকে। সরবদের কথা শেষ হওয়ার পর নীরবদের কথা জানার আগ্রহ নিয়ে আরেকটু এগিয়ে আরেক দোকানে বসলে সেখানেও কয়েকজন জড়ো হন। এঁদের একজন আগের আলোচনায় ছিলেন শ্রোতা। এবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, ভোট নিয়ে যাঁরা বেশি সরব, তাঁরা কিছু না কিছু আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন। সাধারণ বস্তিবাসী এখনো কিছু পায়নি। আর সবাই শুধু সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে, এটাও ঠিক না। হয়রানির ভয়ে তাঁরা ‘বোবা’ সেজে আছেন। পোড়া বস্তির আরেকটু গভীরে গিয়ে কথা হয় আবছার মিয়ার সঙ্গে। পেশায় রিকশা-ভ্যানচালক। বললেন, ‘বস্তির জীবন। আইজ আছি, কাইল লাত্তি মাইরা খেদায় দিলে কী অইব? তাই সবাই নগদ নারায়ণ চায়। তয় হোমরাচোমরা ছাড়া সাধারণ ভোটার কিছু পাইছে বলে হুনি নাই। সবাই আশায় আছে। তয় টেকা পাইলেই যে ভোট দিব, হেইডা শিউর দেওন যাইব না।’ কড়াইল ও সাততলা বস্তি: কড়াইল ও সাততলা বস্তির অনেকেই জানালেন তাঁরা ভোট দেবেন আশপাশের স্থায়ী বাসিন্দা ও মুরব্বিদের পরামর্শে। দুটি বস্তিতেই আঞ্চলিকতা, ব্যক্তি পরিচিতি, আওয়ামী লীগ-বিএনপির ভোটব্যাংক, প্রার্থীদের প্রচার, এমনকি শেষ মুহূর্তে টাকাপয়সাও ভোট কোনদিকে যাবে, তা নির্ধারণ করে দিতে পারে। তবে অনেক ভোটারই এসবের বাইরে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সজাগ। প্রভাব ফেলতে পারে এটিও। কড়াইল বস্তিতে ভোটার ২৬ হাজার, সাততলায় প্রায় ১৫ হাজার। বস্তিবাসী হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভোটার এই দুই বস্তিতেই। ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ দেখা গেছে বেশি। কড়াইল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে, সাততলা পড়েছে ২০ নম্বরে। দুটি ওয়ার্ডেরই কাউন্সিলর নির্বাচনে বড় প্রভাবক বস্তি দুটি। মেয়র প্রার্থীরাও এত বড় ভোটব্যাংক হাতছাড়া করতে রাজি নন। ফলে প্রার্থীদেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বস্তিগুলো। গত শুক্রবার বস্তি দুটিতে ঘুরে দেখা গেল চায়ের দোকান কিংবা ছোট ছোট জটলার পাশে দাঁড়িয়ে ভোটের আলোচনা চলছে। অবশ্য এর আগে বুধবার গিয়ে আলোচনা কম দেখা যায়। বস্তিবাসীরা জানান, ভোট গ্রহণের দিন যত এগিয়ে আসছে, উদ্দীপনাও বাড়ছে। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মচারী আসাদুজ্জামানের বসবাস সাততলার পাশেই। বস্তিতে যাতায়াতও রয়েছে। তিনি বলেন, বস্তিতে সালিস হয়, সেখানে যাঁরা বিচার করেন, তাঁদের বিপদে-আপদে পাশে থাকেন, ভোটারদের ওপর তাঁদের প্রভাব রয়েছে। কড়াইলে কুমিল্লা, চাঁদপুর, শেরপুর, ভোলার মানুষ সবচেয়ে বেশি। সাততলায় প্রায় ৮০ শতাংশ বরিশাল অঞ্চলের। নরসিংদীরও একটা বড় অংশ আছেন। দোকানদার হান্নান চৌধুরী জানান, কড়াইলে বিএনপির ভোট বেশি। তবে বেশির ভাগই মুখ খুলছেন না। ভোট দিতে যাবেন ঠিকই। দুই বস্তির বাসিন্দারা মনে করেন, টাকার কাছে সমীকরণ কিছুটা বদলে যেতে পারে। একজন বললেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট থাকব, বিরোধী পক্ষ কিছু করলে হেরা ধইরা লইয়া যাইব। আর ছাত্রলীগ-যুবলীগ করলে চা-বিস্কুট খাওয়াইব।’ মিরপুর বাগানবাড়ি ও সোবহান রোড বস্তি: মিরপুর-১৪ নম্বর সেকশনের বাগানবাড়ি বস্তিটি ৪ নম্বর আর ভাষানটেকের সোবহান রোড বস্তিটি পড়েছে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাগানবাড়ি বস্তির ভোটের নির্ধারক হতে পারে ‘আঞ্চলিকতা’ আর সোবহান রোড বস্তির ক্ষেত্রে তা ‘মুরব্বিদের কথা’। তবে দুই বস্তির ভোটাররাই বলছেন, শেষ সময়ে টাকার খেলাই বড় নির্ধারক হয়ে দেখা দিতে পারে। দুই বস্তিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোট আছে। গত শুক্রবার দুই বস্তির অন্তত ৬০ জন ভোটারের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নির্বাচন নিয়ে দুই বস্তিতেই আওয়ামী লীগের পক্ষের ভোটাররা বেশ সরব। আর বিএনপি-সমর্থক থাকলেও তাঁরা নীরব। মিরপুর-১৪ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বাগানবাড়ি বস্তি। বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দা কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে আগত। জাতীয় নির্বাচনে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন বলে জানান। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে আওয়ামী লীগের মেয়র ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থক একাধিক ভোটার জানালেন, সব ছাপিয়ে আর্থিক লাভালাভের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে উঠতে পারে ভোটে। এ ওয়ার্ড থেকে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী সাব্বির দেওয়ানের প্রতীক করাত। কিন্তু বস্তিতে তাঁর নির্বাচনী প্রচার দেখা গেল না। তবে কয়েকজন ভোটার আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলেন, পরিস্থিতির কারণে তাঁরা এখন নীরব আছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী রইস মিয়া বললেন, ‘বস্তিতে তো সব দল ঢুকতে পারতাছে না। যা করার নিজেগোরেই ভোটকেন্দ্রে গিয়া বুইঝা করতে হইবো।’ সোবহান রোড বস্তির ভোটারদের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার চেয়ে প্রভাবশালীদের মতামতই নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে বলে ভোটাররা মনে করছেন। এখানেও শেষ পর্যন্ত টাকার খেলা ভোটে প্রভাব ফেলবে বলে বস্তিবাসীর মাঝে কানাঘুষা আছে। তবে প্রচার-প্রচারণায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরাই এগিয়ে। ভোট দিলেও বস্তিবাসীর নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি পায় না। এ জন্য অনেকেই প্রকাশ্যে জানান, নগদ প্রাপ্তিই তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সবজি বিক্রেতা আকবর আলী বলেন, ‘তারা তো (প্রার্থীরা) আমগো চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে আসে না। আমরা ভোট না দিলেও তাদের কিছু হইবো না। তাই যা পাই নিয়া ভোটটা দিয়া দিমু।’

No comments:

Post a Comment