Monday, April 13, 2015

৬০ দিনের সহিংসতায় ক্ষতি ১৭ হাজার কোটি টাকা:কালের কন্ঠ

গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ এবং মাঝেমধ্যে হরতালে এ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে নতুন তথ্য দিল বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, ৬ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের সংঘাত ও সহিংসতায় উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে ২২০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশ অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা
ঠিক করা হয়েছে, সেটি অর্জিত হবে না। প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৬ শতাংশ। গতকাল রবিবার 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশকালে এসব তথ্য তুলে ধরেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি ইউহানেস জাট। এদিকে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, 'বিশ্বব্যাংকের এই তথ্যের সঙ্গে আমি একমত নই।' জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি হবে বলে দাবি করেন তিনি। গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাটের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংস্থাটি সব সময় এ ধরনের আভাস দিয়ে থাকে। কিন্তু বছর শেষে সেটি কখনো ফলে না। প্রসঙ্গত, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা তিন মাসের হরতাল-অবরোধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও ডিসিসিআই ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়ে আসছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র এরই মধ্যে তুলে ধরেছে। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সহিংসতায় দেশের উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এটা চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫৫ শতাংশ। ৮১ দিনের হরতাল-অবরোধের ওপর ভিত্তি করে ওই গবেষণা করা হয় বলে জানিয়েছে সিপিডি। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) মতে, এক দিনের হরতাল-অবরোধে ক্ষতি হয় দুই হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত তিন মাসে হরতাল ও অবরোধের কারণে অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর এফবিসিসিআইয়ের হিসাবে, এক দিনের হরতাল-অবরোধজনিত ক্ষতি দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ৬ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের সংঘাত ও সহিংসতার আলোকে বিশ্বব্যাংক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে গবেষণা করেছে। দেখা গেছে, ওই সময়ে কৃষি, শিল্প ও সেবা- এই তিন খাতে ক্ষতি হয়েছে ১৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এটি জিডিপিতে যোগ হতো। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেবা খাত। এ খাতে ৬৮ শতাংশ উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতি হয়েছে শিল্প খাতে (২৫ শতাংশ)। আর কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে ৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, এবার এমন এক সময়ে (শুষ্ক) রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়, যখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থাকে তুঙ্গে। শাকসবজি উৎপাদন ও বেচাকেনার পাশাপাশি পর্যটনের ভরা মৌসুম থাকে ওই সময় (জানুয়ারি-মার্চ)। আমনের উৎপাদন ছিল উঠতির দিকে। এ জন্য এ বছর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি হয়েছে। ড. জাহিদ হোসেন অবশ্য স্বীকার করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাঁরা ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব দিয়েছেন, সেটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। ব্যবসায়ীরা এবং অন্যান্য গবেষণা সংস্থাও অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই এসব তথ্য দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, অনুমান বলতে আবার এটিও নয় যে এসব তথ্য আকাশ থেকে আনা হয়েছে। গত ছয় মাসের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করত, তাহলে বছর শেষে ৬.৪ শতাংশ থেকে ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতো। কিন্তু হরতাল ও অবরোধের কারণে সেটি ১ শতাংশ কমে ৫.৬ শতাংশ হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির হালচিত্র গতকাল প্রকাশিত 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, কাঠামোগত সংস্কারের অভাব ও বৈশ্বিক মন্দার পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোও স্থিতিশীল রয়েছে। ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। সেই শক্তি দিয়ে তারা অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। তিনি জানান, গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বহির্বাণিজ্যে স্বস্তির পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে রপ্তানি বাণিজ্য ভালো হলেও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। ইউরোর দর বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে রপ্তানি কিছুটা ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় রাজস্ব আদায়ের হারও কম। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় সরকারের যে অর্থ ব্যয় হয়, সেটিও আশানুরূপ নয়। ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মত, দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাংকঋণের সুদের হার অস্বাভাবিক নয়। এটি স্বাভাবিক অবস্থায়ই রয়েছে। তবে সুদের হার কমাতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাতে হবে। এগুলো করতে পারলে ব্যাংকের সুদের হার কমে আসবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জও চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা রাজনৈতিক অস্থিরতা। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পূর্বশর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তবে বিশ্ব অর্থনীতির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির অন্যতম বাজার। সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে ইউরো শক্তিশালী হয়েছে। ইউরোর বিপরীতে ডলারের দাম পড়তির দিকে। এ জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কাঠামোগত দুর্বলতাও রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা, সরকারি ব্যাংকের সংস্কার, পিপিপি আইন কার্যকর, অর্থনৈতিক অঞ্চল আইনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংস্কার কার্যক্রমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন ড. জাহিদ। জনসংখ্যার বোনাস-কাল কাজে লাগাতে হবে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ফাঁদে আটকে আছে। এটি বাড়ছে না। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগের হারও বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, তা মোট জিডিপির ২৮ শতাংশ। এটিকে বাড়িয়ে ৩২ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আর এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে 'জনসংখ্যার বোনাস-কাল'কে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. জাহিদ বলেন, দেশে এখন কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি সাত লাখ। শ্রমবাজারে এখন পুরুষের অংশগ্রহণ ৮২ শতাংশ। আর নারীদের অংশগ্রহণ ৩৩ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে পারিবারিক যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। ড. জাহিদ বলেন, জাপানের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশ যদি নারীর অংশগ্রহণ ৩৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৮ শতাংশে উন্নীত করতে পারে তাহলে বছর শেষে জিডিপির হার বাড়বে দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ মোট জিডিপির প্রবৃদ্ধি যদি হয় সাড়ে ৬ শতাংশ, সেটির সঙ্গে আরো দশমিক ৭ যোগ হয়ে হবে ৭.৩ শতাংশ। তিনি বলেন, থাইল্যান্ডে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশেও যদি নারীর অংশগ্রহণ ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয় তাহলে জিডিপির হার বাড়বে ১.৬ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ৮২ শতাংশ পুরুষের অংশগ্রহণ রয়েছে, সমভাবে নারীরও অংশগ্রহণ যদি ৮২ শতাংশে নেওয়া যায়, তাহলে জিডিপিতে ১.৮ শতাংশ বাড়তি যোগ হবে।    

No comments:

Post a Comment