Monday, April 13, 2015

ভালো নেই সাক্ষীরা:কালের কন্ঠ

যাঁদের সাক্ষ্যে একের পর এক মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার হচ্ছে, সাজা হচ্ছে, ফাঁসিও হচ্ছে; যাঁরা সাহস করে সাক্ষ্য না দিলে হয়তো জাতির এই কলঙ্কমোচন সম্ভব হতো না- সেই সাক্ষীরা আজ ভালো নেই। জীবনের বসন্তবেলায় একাত্তরে এক দফা নির্যাতিত হয়েছেন পৈশাচিকভাবে; এখন আবার জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে বিচারের ট্রাইব্যুনালে সেই সব নির্যাতনের সাক্ষ্য দিয়ে পড়েছেন প্রাণের হুমকিতে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি প্রতিনিয়ত প্রেতের মতো
তাড়া করছে তাঁদের। নানা রকম হুমকি-ধমকি, হয়রানি-চোখরাঙানি আর পুলিশ পাহারায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে অনেকের। তাঁদের জন্য বহু প্রত্যাশিত 'সাক্ষী সুরক্ষা আইন'টিও আলোর মুখ দেখেনি। এই অবস্থায় জীবন সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে আরো অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা। শেরপুরের সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হাছেনা বানু। একাত্তরে স্বামী আব্দুল লতিফকে হারিয়েছেন। হারিয়েছেন নিজের সর্বস্ব। নিজের বলে কেউ নেই। এই বৃদ্ধ বয়সেও অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা চালাতে হয় তাঁকে। থাকতেও হয় অন্যের বাড়িতে। সহায়তা বলে কিছু টাকা পান 'বিধবা ভাতা'। একাত্তরের নরপিশাচ আলবদর সদস্যদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যও দিয়েছেন এই সাহসী নারী। তাঁর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে অপরাধী আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয় এবং তা কর্যকরও হয়েছে। হাছেনা বানু এই রায় কার্যকর হওয়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি, তবে চিন্তা তাঁর নিরাপত্তা আর দৈন্যদশার জীবন নিয়ে। কারণ যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা এখন তাঁর চেয়েও হাজার গুণ প্রতিপত্তিশালী। শঙ্কায় জীবন পার করছেন হাছেনা বানু। সরকারের পক্ষ থেকে যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে তা স্থায়ী নয় বলে জানা গেছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাত নম্বর সাক্ষী ছিলেন জালাল উদ্দিন। শেরপুর জেলার আলোচিত বিধবাপল্লী সোহাগপুরের বাসিন্দা তিনি। একাত্তরে বাবা-ভাইসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি। এই সাক্ষী যে অভিযোগের ওপর সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেই অভিযোগে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। অথচ এই সাক্ষী স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকেই স্থানীয় জামায়াত-শিবির প্রতিনিয়ত জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে তাঁকে, প্রকাশ্যে ও ফোনে। জালাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জীবিকা অর্জনের জন্য মাঠে কাজ করতে যাব, সেটাতেও ভয়। আবার খাবার কিনতে বাজারে যাব, সেখানেও শঙ্কা থাকে- ওরা সুযোগ পেলেই হামলা করবে। এখন আমাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। জামায়াত-শিবিরের লোকজন বলেছে, আওয়ামী লীগ সরকার আর কয় দিন আছে, সরকার বদল হলেই তোদের দেখে নেব।' মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলার সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য একটি আইন তৈরির জন্য আইন মন্ত্রণালয় ২০১১ সালেই উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাক্ষী সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। আমরা ২০১১ সালে এই আইন করার জন্য একটি খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলাম। যতটুকু শুনেছি সেটি আর এগোয়নি।' তিনি আরো বলেন, 'এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বেশির ভাগ সাক্ষীই তাদের জন্য স্থায়ী নিরাপত্তা চেয়েছে। তাই এই আইনটি করা দরকার। তা ছাড়া নিরাপত্তার আরো যে দিকগুলো রয়েছে সেগুলোও ভাবতে হবে সরকারকে।' বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু আইন করেই সাক্ষীদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে না। আরো অনেক দিক রয়েছে নিরাপত্তার জন্য। নিরাপত্তা কিভাবে দেওয়া যায়, আমরা সে বিষয়ে ভাবছি।' আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সাক্ষী সুরক্ষা আইন করার জন্য ২০১১ সালে আইন কমিশন সুপারিশ তৈরি করেছিল। এরপর মন্ত্রণালয় আইনের একটি খসড়া প্রস্তুত করে। কিন্তু আইনটি প্রস্তুত করার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তাই আইন মন্ত্রণালয় খসরাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কালের কণ্ঠের শেরপুর প্রতিনিধি হাকিম বাবুল জানান, সোহাগপুর বিধবাপল্লীর শহীদ রহিমুদ্দির স্ত্রী করফুলি বেওয়া (৭০) বলেছেন, 'কামারুজ্জামানের ফাঁসি অইছে, মনে খুশি লাগতাছে। কিন্তুক আশপাশের মাইনষেরা কয়, সরকার বদলাক, তহন সাক্ষী দেওনের মজা টের পাবা। তখন ডর ডর করে। আবার ভাবি, একাত্তুরে তো আমগর সবই গেছে, অহন আর কী অবো। মুনে সাহস জোগাই। আমরা অহন বুড়া অইয়া গেছি, শরীরে হিমুন শক্তি-সামর্থ্যও নাই। আমগরে দিনচালানি খুব কষ্ট। হুনছি সরকার বীরাঙ্গনাগরে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করতাছে। আমগরে সোহাগপুরের শহীদ পরিবারের বিধবারা আশায় বুক বাইন্দা আছি, সরকার আমগরে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়া শেষ জীবনডা সরমান (সম্মান) নিয়া মরবার বাও (ব্যবস্থা) কইরা দেক।' রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী শহীদ ইব্রাহিমের স্ত্রী হাফিজা বেওয়া (৬২) বলেন, 'মেলা কষ্ট করছি। রেজাকার-আলবদররা আমার ইজ্জত নিছে, সোয়ামীরে মারছে; ভাসুর, বোনজামাই, দুই চাচা- সাতজনরে মারছে মাঝেমধ্যেই না খাইয়্যা থাহুন নাগে। খিদার জ্বালা আর সহ্য অয় না।' তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুজন চৌকিদার পাহারায় রয়েছেন। দুই দিন ধরে তাঁরা পাহারা দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে পুলিশ টহল দিচ্ছে। হাফিজা বেওয়া বলেন, সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকেই মাঝেমধ্যেই কে বা কারা তাঁর বাড়িতে ঢিল ছোড়ে, নানা ধরনের অত্যাচার করে। রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী শহীদ ছফির উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন বলেন, 'আমরা ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় ঘোষণার সময় থেকে কাকরকান্দি বাজারে ইউনিয়ন পরিষদে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। পুলিশ মাঝে মাঝে বিধবাপল্লীতে টহল দেয়। সেখানে ফোন দিলে পুলিশ আসে। কিন্তু এই পুলিশ ক্যাম্পও তো কয় দিন পর উঠে যাবে। তখন আমাদের কী হবে? মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে, মোটরসাইকেলে করে এলাকায় অপরিচিত লোকজন আসে, এর ওর কথা জিজ্ঞেস করে। তখন চিন্তা হয়। এ জন্য আমরা সোহাগপুর বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারগুলোসহ বাজারের ব্যবসায়ী, এনজিও, ব্যাংক কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান-মেম্বর মিলে কাকরকান্দি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পটি স্থায়ী করার জন্য ডিসি-এসপির কাছে লিখিত আবেদন দিয়েছি। সরকার এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিবে বলে আশা করি।' আবেদনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকীর হোসেন বলেন, 'আমি সরকারের কাছে এ ব্যাপারে দৃৃৃৃৃৃৃৃষ্টি আকর্ষণ করব।' পুলিশ সুপার মো. মেহেদুল করিম বলেন, সোহাগপুরবাসীর আবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নূজহাত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, একাত্তরে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবার পরবর্তী সময়ে ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁরাও সে রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন এখন। সরকার সে তুলনায় সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধান করতে ব্যর্থর্ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা করেনি। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল 'সাক্ষী সুরক্ষা আইন', সেটি এখনো করেনি সরকার। সরকারের উচিত এটা দ্রুত করা। এ ছাড়া নিরাপত্তার জন্য সামাজিক বলয় তৈরি করতে হবে। এ জন্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল মানুষকে সংগঠিত করে এই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এই বলয় তৈরিতে ক্ষমতাসীন রজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। ডা. নূজহাত বলেন, 'কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে যে সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে, তাঁরাও নিরাপত্তাহীনতায়। শুধু নিরাপত্তাহীনতায় নয়, অনেকের জীবনও চলছে না অর্থাভাবে। শুনেছি সোহাগপুরের বীরাঙ্গনা হাফিজা, হাছেনাসহ অনেক বিধবা ৭০-৭৫ বছর বয়সে অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ দিকটাতেও সরকারকে নজর দিতে হবে।' মানবতাবিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী পিরোজপুরের মোস্তফা হাওলাদারকে ২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর রাতে কুপিয়ে জখম করা হয়। গত ৯ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন মামলার সাক্ষীরা আরো নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইউনূস আলী কালের কণ্ঠকে জানান, এই মামলায় কয়েকজন আসামি করাগারে থাকলেও কয়েকজন জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে। মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের পরদিন ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজেই উষ্মা প্রকাশ করেছেন সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে। ট্রাইব্যুনাল উপস্থিত প্রসিকিউটরদের লক্ষ্য করে বলেন, 'সাক্ষীকে যদি নিরাপত্তা না দেন, তাহলে কেন তাদের সাক্ষী দিতে আনছেন?' ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'আপনারা দ্রুত ব্যবস্থা নিন। আপনারা সরকারকে চাপ দিন। সরকারকে বলেন, সাক্ষীর নিরাপত্তা না দিলে কোনো সাক্ষী আনতে পারব না।' কিন্তু এত দিনেও সরকার কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি এ বিষয়ে। পিরোজপুর প্রতিনিধি শিরিনা আফরোজ জানান, সাঈদীর মামলার বাদী মাহাবুবুল আলম বলেছেন, জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর দিনের বেলায় লাঠিসোঁটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে তাঁর টেংরাখালী গ্রামের বাড়িতে তাণ্ডব চালায় এবং তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়ে বীরদর্পে চলে যায়। তিনি প্রশাসনের কাছে সরকারি সহায়তায় শহরে নিরাপদে মাথা গোঁজার ঠাঁই চেয়েছেন, কিন্তু পাননি। আরেক সাক্ষী আ. হালিম বাবুল খলিফা বলেন, 'ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যেতে পারি না। হাটবাজারে যাব, তাও পারি না, রাস্তায় বের হলেই শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হই। কখন কী হয়ে যায়, জানি না।' সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা দ্বিতীয় মামলার বাদী মানিক পশারী বলেন, 'এই বৃদ্ধ বয়সেও মামলা দিয়েছিলাম সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু প্রতিনিয়ত হুমকি আর পুলিশের পাহারায় এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। সাক্ষী আশীষ মণ্ডল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'পাক হায়েনারা পিরোজপুরে প্রথম প্রবেশ করেই রাজাকার-আলবদরদের নির্দেশে আমাদের বাড়ি-ঘরে নির্বিচারে আগুন জ্বালিয়ে বিরান ভূমিতে পরিণত করেছিল, সেই দৃশ্য আজও ভোলার নয়। আর এখন তাদের দোসরদের ভয়ে পুলিশ পাহারায় দিন কাটাচ্ছি। আমরা যেমন রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে গোটা জাতির পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছি তেমনি রাষ্ট্রের কাছেও আমরা নিরাপদ আবাস চাই।' আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, হাজারো সমালোচনা আর অনাস্থার ভেতর পথচলা শুরু করে ৩০ লাখ শহীদ আর চার লাখ মা-বোনের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই, তাও আবার ৪০ বছর পর। এই লড়াইয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা। তাঁরা নানা ঝুঁকির মধ্যে থেকেও জীবন বাজি রেখে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সরকার নানা সময় তাঁদের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সাক্ষীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায়। জানা যায়, ২০১২ সালে সাক্ষীদের সুরক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'সাক্ষী সুরক্ষা কেন্দ্রীয় কমিটি' গঠন করে। এরপর ২০১৩ সালের মার্চে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের নিরাপত্তা জোরদার করতে স্থানীয় পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকদের প্রতি একটি আদেশ জারি করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই উদ্যোগের পর পুলিশ বেশ সচেতন হয়। কিন্তু স্থায়ীভাবে নিরাপত্তা দিতে পারেনি বলে একাধিক সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক এস এম রানা জানান, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মামলার সাক্ষী আছেন চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। তাঁদের অনেকেই এখনো ভীতির মধ্যে দিনযাপন করছেন। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরু বাঙ্গালী বলেন, 'সাকা চৌধুরীর মামলায় সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য আমাকে এক কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এটা অগ্রাহ্য করে সাক্ষ্য দেওয়ায় আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এই নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলাম।' বাগেরহাট প্রতিনিধি বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্তী জানান, কচুয়া উপজেলার শাখারিকাঠি গ্রামে গণহত্যা মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা নিমাই চন্দ্র দাস বলেন, মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে কয়েক দিন আগে রাজাকার আবদুল লতিফের এক আত্মীয় তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। স্থানীয় বাধাল বাজারে একটি দোকানে কয়েকজনের উপস্থিতিতে তাঁর নাম উল্লেখ করে ওই হুমকি দেওয়া হয়। বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো. নিজামুল হক মোল্ল্যা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বিষয়ে পুলিশ সব সময় খোঁজখবর রাখছে। সাক্ষীরা চাইলে পুলিশ তাঁদের সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেবে। সাক্ষী নিমাই চন্দ্র দাসকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, এ ব্যাপারে নিমাই চন্দ্র দাস তাঁকে কিছুই জানাননি। তার পরেও খোঁজখবর নিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান। কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি আলতাফ হোসেন মিন্টু জানান, গতকাল রবিবার সকালে ঘাটারচর এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, প্রায় দেড় বছর আগে একজন রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে শহীদ আরব আলী ও শহীদ দরবেশ আলীর ভাই তৈয়ব আলী, শহীদ রাজা মিয়ার ছেলে মো. মনির ও তাঁর স্ত্রী রসমাতন বিবি ২৯ দিন নিখোঁজ ছিলেন। এখন তাঁরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নন। তৈয়ব আলী শুধু বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হচ্ছে, এতে আমি খুশি। এর বেশি আর কিছু বলতে চাই না।' এ ছাড়া এক রাজাকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় ঘাটারচর এলাকার শহীদ পরিবারের এক সদস্যকে বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।    

No comments:

Post a Comment