Thursday, April 9, 2015

নূর হোসেন ও সেই তিন র‌্যাব কর্মকর্তা অভিযুক্ত:কালের কন্ঠ

নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। এতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেন, তিন র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিসহ ১৬ জনকে। অভিযুক্ত নূর হোসেন ভারতের কলকাতায় আর আলোচিত ওই তিন র‌্যাব কর্মকর্তা দেশেই গ্রেপ্তার আছেন। নারায়ণগঞ্
জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর নৃশংসভাবে খুনের ঘটনার ১১ মাস পর গতকাল বুধবার বিকেলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করেন। অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর ফজলুর রহমান চার্জশিট দাখিলের সত্যতা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনী রূপমের আদালত ১১ মে শুনানির দিন ধার্য করেছেন। আদালতে দাখিল করা দুটি মামলায় ৩২ পৃষ্ঠা করে চার্জশিটে সাতজনকে অপহরণ ও পরে হত্যার ঘটনায় ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলায় ১৬২ ধরনের আলামত উদ্ধার দেখানো হয়েছে। মামলায় এখন পর্যন্ত ৩২ জন গ্রেপ্তার রয়েছে। অভিযুক্ত যে ২২ জন গ্রেপ্তার : মামলায় অভিযুক্ত ৩৫ জনের মধ্যে ২২ জন গ্রেপ্তার রয়েছেন। তাঁরা হলেন- চাকরিচ্যুত র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, উপ-অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানা, ল্যান্স নায়েক বিল্লাল হোসেন, সাবেক এসআই পূর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার মো. ইমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. সিহাব উদ্দিন, রেডিও অপারেটর গেইন (আরওজি) মো. আরিফ হোসেন, এএসআই বজলুর রহমান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার ও গাড়িচালক নাসিরউদ্দিন, সিপাহি নুরুজ্জামান, বাবুল হাছান, সিপাহি সাবেক সেনা সদস্য আসাদুজ্জামান এবং নূর হোসেনের প্রধান বডিগার্ড মর্তুজা জামান চার্চিল, প্রধান ক্যাশিয়ার আলী মোহাম্মদ, ক্যাশিয়ার সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার সম্পাদক আবুল বাশার, মাদক স্পট, জুয়া ও অশ্লীল নৃত্য পরিচালনাকারী রহম আলী ও মিজানুর রহমান। যে ১৬ জনের অব্যাহতি : অব্যাহতিপ্রাপ্ত এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামি হলেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি ইয়াসিন মিয়া, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সদস্য ইকবাল হোসেন, নিহত কাউন্সিলর নজরুলের চাচাশ্বশুর হাসমত আলী হাসু, থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন আশিক। মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন; কিন্তু অব্যাহতি পেয়েছেন এমন ১০ জন হলেন নূর হোসেনের বডিগার্ড মহিবুল্লাহ, তানভীর, ইয়াসিন, আলমগীর, গাড়িচালক সোনা মিয়া, জুয়েল আহম্মেদ, মিজান, আবদুর রহিম, আরিফুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া রাজীব নামের একজনকে পূর্ণাঙ্গ নাম ও পরিচয় না পাওয়ায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পলাতক ১৩ জন : চার্জশিটে অভিযুক্ত ৩৫ জনের মধ্যে ১৩ জনকে পলাতক দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে নূর হোসেনসহ সহযোগী পাঁচজন ও র‌্যাবের আট সদস্যের নাম রয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত ৩৫ জনের মধ্যে নূর হোসেনকে পলাতক দেখানো হয়েছে। পলাতক ১৩ জন হলেন নূর হোসেন, তাঁর সহযোগী ভারতে গ্রেপ্তার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন। এ ছাড়া র‌্যাবের রয়েছেন আরো আটজন। তাঁরা হলেন করপোরাল লতিফুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলী, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান। এ মামলায় ১২৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট কে এম ফজলুর রহমান বলেন, এই মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে নূর হোসেনসহ র‌্যাবের আরো তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে। হত্যাকাণ্ডে যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়েছে, আলামত হিসেবে সেগুলো আদালতে দাখিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে যাঁদের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন তাঁদেরকেই অভিযুক্ত করেছেন এবং যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়নি তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ১৬৪ ধারায় যাঁরা জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ মামলায় আগামী মে মাসের ১১ তারিখে চার্জশিট গ্রহণের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। নূর হোসেনকে দেশে এনে রিমান্ডে নেওয়া হোক- বিউটি : সাত খুনের পর দুটি মামলার মধ্যে সেলিনা ইসলাম বিউটির মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছিল। এ ছয় আসামির মধ্যে নূর হোসেনকে গত বছরের ১৪ জুন ভারতের কলকাতায় গ্রেপ্তার করা হলেও এজাহারভুক্ত অন্য পাঁচ আসামি রয়েছে পলাতক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আর এ পাঁচজনকেই অব্যাহতি দেওয়ায় বুধবার বিকেলে আদালতে উপস্থিত হয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। বিউটি বলেন, 'আমার মনে হয় অনেক কিছু গোপন রাখা হয়েছে। আমি চাই নূর হোসেনকে দেশে এনে রিমান্ডে নেওয়া হোক। আমার মামলায় ছয়জনকে আসামি করেছিলাম। কিন্তু একজনকে রেখে কিসের জন্য পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হলো, সেটা আমি আমার আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করব। আলোচনা করে যদি মনে হয় তদন্তে কোনো সমস্যা রয়েছে, তাহলে আমি নারাজি দেব। কারণ আমার স্বামী হত্যার আগে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারিতে রাস্তার কাজ নিয়ে যখন বিবাদ হয়, তখন আমার স্বামীকে মারতে অস্ত্র নিয়ে তারা এসেছিল। তাদের সবার হাতে একটা-দুটা করে অস্ত্র ছিল। তাদের কেন বাদ দেওয়া হলো, সেটা দেখব আমরা।' অন্যদিকে চন্দন সরকার ও গাড়িচালক ইব্রাহিমকে অপহরণ ও হত্যা মামলার বাদী ছিলেন চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। এ মামলায় আসামি অজ্ঞাতপরিচয় বলা হয়েছিল। নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনলে আরো নাম আসত : অভিযোগপত্র আদালতে দাখিলের পর বাদীপক্ষের আইনজীবী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে যদি সরকার দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করত তাহলে অভিযোগপত্রে আরো অনেকেরই নাম আসত। অতি দ্রুত নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে এ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি জানান তিনি। ১৬ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যাপারে সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, 'অভিযোগপত্রের নথি তুলে আমরা আইনজীবীরা আগে সেটা পর্যালোচনা করে দেখব কেন তাদের বাদ দেওয়া হলো। পরবর্তী সময় আমরা অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেব। যারা মামলা দায়েরের পর বাদীকে হুমকি-ধমকি দিয়েছে তাদের কেন অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দেওয়া হলো, সেটাও দেখব আমরা।' সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়েছে- এসপি: সাত খুনের ঘটনা তদন্তের বিষয়ে 'সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতা' বজায় রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন বলেন, দীর্ঘ ১১ মাস জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল তদন্ত করে সাত খুনের মামলার অভিযোগপত্র তৈরি করে তা দাখিল করেছেন। ওই খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়নি তাদের অব্যাহতি দিতে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এ তদন্ত কার্যক্রমে যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানান পুলিশ সুপার। গতকাল সন্ধ্যায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের পর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এসব কথা জানিয়েছেন। পুলিশ সুপার বলেন, নূর হোসেন অন্য একটি দেশের জেলখানায় আটক রয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আসার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে। তাঁর জন্য অপেক্ষা করে এত বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। নূর হোসেনকে যখনই দেশে ফিরিয়ে আনা হবে, তখনই তাঁকে কারাগারে পাঠানো হবে। ধন্যবাদ জানাল নাগরিক কমিটি : নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ বি সিদ্দিক সাত খুন মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, দেরিতে হলেও অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এ জন্য সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বলেন, সাত খুনের ঘটনা নারায়ণগঞ্জের সুনাম অনেকটাই ক্ষুণ্ন করেছে। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে- এমনই আশা করেন তিনি। পৈশাচিক সেই হত্যাকাণ্ড : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। পরদিন ২৮ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী। কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান করে মামলায় আসামি করা হয় ছয়জনকে। ৩০ এপ্রিল বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জন এবং ১ মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল। পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাব-১১-এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুলের পরিবারের সদস্যরা। নজরুল ইসলামের শ্বশুর অভিযোগ করেন, ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবকে দিয়ে ওই সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন নূর হোসেন। এ অভিযোগের পর র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদ, সাবেক অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাকে চাকরিচ্যুত করা হয় গত ৬ মে। ১৭ মে রাত দেড়টার দিকে ঢাকার সেনানিবাস এলাকা থেকে মিলিটারি পুলিশ ও ক্যান্টনমেন্ট থানার পুলিশ এবং নৌবাহিনীর গোয়েন্দারা এম এম রানাকে আটক করে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কাছে তুলে দেন। পরে এ তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

No comments:

Post a Comment