১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে নানা অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠায় নড়েচড়ে বসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর। সব কটি জেলার নিয়োগপ্রক্রিয়া খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি জেলার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। তদন্ত করতে একাধিক দল কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি আলাদা তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গত ৪ এপ্রিল কালের কণ্ঠে 'পুলিশে অদ্ভুত কৌশলে নিয়োগ বাণিজ্য' শিরোনামে খবর
প্রকাশিত হয়। এর পরই তদন্তে নামে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুলিশে নিয়োগে নানা অনিয়মের খবরের পরিপ্রেক্ষিতে সব কটি জেলার নিয়োগ তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন সংসদ সদস্যও নিয়োগে অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগ করেছেন। জামায়াত-শিবিরের লোকজনও পুলিশে ঢুকে পড়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তাদের কিছুতেই ছাড় দেওয়া হবে না।' তদন্তেই সব কিছু বের হয়ে আসবে বলে তিনি আশাবাদী। স্বরাষ্ট্রসচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কিছু জেলা থেকে অভিযোগ এসেছে। সেগুলো খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।' স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পুলিশে ৫০ হাজার নতুন সদস্য নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। সে অনুযায়ী গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬৪ জেলায় নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হয়। প্রথম পর্বে ১০ হাজার সদস্যের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে তা সম্পন্ন হয়েছে। তবে নিয়োগে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ করে এক জেলার বাসিন্দা অন্য জেলায় গিয়ে আবেদন করেছে। তার মধ্যে ঢাকা জেলায় এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে। অন্য জেলায়ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, তাঁদের স্ত্রী, পুলিশের অসাধু কর্মকর্তা ও দালালদের তদবির ছিল সবচেয়ে বেশি। রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কক্সবাজার ও মৌলভীবাজার জেলায়ও নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও অর্থ লেনদেন নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এসব এলাকার সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতারাই এসব অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় তদন্তের নির্দেশ দেয়। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে বেশির ভাগ অভিযোগই এসেছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে। একটি জেলার নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, ওই জেলার একজন সংসদ সদস্য ৫০ জনকে নেওয়ার জন্য তালিকা দেন পুলিশ সুপারকে (এসপি)। নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ৫০ জনের মধ্যে ছয়জনের বাড়িই অন্য জেলায়। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে তাদের চাকরি দেওয়ার জন্য তালিকা পাঠানো হয়। এ জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে। বিষয়টি ধরা পড়ায় এবং যোগ্যতা না থাকায় তালিকার অনেকের চাকরি হয়নি। চাকরি না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট জেলার এসপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এসপি কালের কণ্ঠকে বলেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যদি এসপি কাউকে নিয়োগ দেন এবং পরে তা ধরা পড়ে, তাহলে ওই এসপির চাকরি হারানোর সম্ভাবনা থাকে। আর স্থানীয় কোনো রাজনীতিকের তালিকা থেকে নিয়োগ না দিলে অভিযোগের কারণে এসপি বড়জোর বদলি হবেন। এ কারণে অযোগ্য কারো পক্ষে তদবির এলেও এসপি কখনোই চাকরি দেওয়ার সুপারিশ করেন না। পুলিশ সদর দপ্তরের আরেক কর্মকর্তা জানান, ২০০৮ সালে ছয় হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাদের মধ্যে ধরা পড়ে আটজন নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে খাটো। পরে তাদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের দেওয়া সনদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যাচাইয়ের পর কারো সার্টিফিকেট ভুয়া প্রমাণিত হলে তার চাকরি চলে যাবে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, 'প্রতিটি জেলায় নিয়োগের বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। বছর দুয়েক আগে জালিয়াতি করে পুলিশে চাকরি নেওয়ায় ২৩ কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হয়েছিল। এবারও তদন্তে কারো বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণিত হলে তাদেরও একই পরিণতি হবে। সূত্র জানায়, ঝিনাহদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই (বর্তমান সংসদ সদস্য) ঝিনাইদহের এসপি আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে। ঠাকুরগাঁওয়ের এসপি আবদুর রহিম শাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একই অভিযোগ করেছেন ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলাম। অভিযোগে বলা হয়েছে, কমপক্ষে ৬৭ জনের কাছ থেকে প্রায় সাত লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের গোলাম মোস্তফা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের আবদুল ওদুদ বিশ্বাস গত ৮ মার্চ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ করা হয়েছে। এসপি বশির আহমেদ ছয়-সাত লাখ করে টাকা নিয়ে জামায়াত-বিএনপির লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন। ফলে দলীয় নেতা-কর্মীর কাছে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment