Saturday, April 25, 2015

সমান সুযোগ তৈরি করতে পারেনি ইসি:প্রথম অালো

‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ সৃষ্টির মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে অস্থির রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসার লক্ষণ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ১৮ মার্চ নির্বাচনের তফসিলের পর থেকে ইসির বিতর্কিত ভূমিকা, খালেদা জিয়ার ওপর তিন দফা হ
ামলা, কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রার্থীর নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, রাজনৈতিক নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যসহ বিভিন্ন কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অবশ্য সরকারপন্থী সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও লেখক সৈয়দ শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যত শঙ্কা বা আশঙ্কা থাকুক না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। এই নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সরল, স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাভাবিক হবে। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে-ই করুক এমন কাজ, মোটেও ঠিক করেনি। এটা অন্যায় এবং অসমর্থনযোগ্য। আর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য না করে সৈয়দ হক বলেন, ‘আমি অবশ্য মনে করি, সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই।’ সেনা মোতায়েন নিয়ে সর্বশেষ বিতর্কে জড়ালেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকেই শুরু হয় ইসির পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকাণ্ড। শুরুতে শুধু পুলিশের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করায় সমালোচনায় পড়ে ইসি। গত ২৫ মার্চ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বিএনপিপন্থী শত নাগরিক কমিটির একটি প্রতিনিধিদল দেখা করতে গেলে কমিশনারদের না ডেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) একাই বৈঠক করেন। তাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দু-এক দিন বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। বৈঠক শেষে সিইসি কমিশনারদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই এককভাবে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হবে না। এরপর ১ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সিইসির সঙ্গে ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ সৃষ্টির দাবি জানিয়ে সাক্ষাৎ করে। সেদিনও অন্য কমিশনারদের ডাকেননি সিইসি। ১৮ মার্চ তফসিল ঘোষণা করলেও ৮ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়, মন্ত্রিসভার সদস্যরা যাতে নির্বাচনী প্রচারে অংশ না নেন, সে জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেওয়ার। চট্টগ্রামে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনসহ তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ততদিনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন এবং এ নিয়ে লেখালেখি হয়। তফসিল ঘোষণার তিন সপ্তাহ পর মূলত গণমাধ্যমের চাপেই কমিশন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয় ইসি। কমিশন দেরিতে চিঠি দেওয়ায় ১২ এপ্রিল সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে বলেন, আচরণবিধির বিষয়ে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। এরশাদ প্রচার চালাতে পারেন না, এ কথা বললেও কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। তফসিল ঘোষণার পরও সিটি করপোরেশন নিয়োগ, পদোন্নতি ও উন্নয়নকাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। এ ক্ষেত্রেও ইসির কোনো নজরদারি ছিল না। সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ার পর নতুন যেকোনো নিয়োগ বা উন্নয়নকাজ বন্ধ রাখতে চিঠি দেয় ইসি। নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে দেখা গেছে, সরকার-সমর্থক প্রার্থীরাই আচরণবিধি তুলনামূলক বেশি লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেনি ইসি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসির উদ্যোগ ছিল সরকার-সমর্থকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার পর বিএনপি-সমর্থক দুই মেয়রপ্রার্থীকে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। সড়ক আটকে ও গাড়িবহর নিয়ে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার ধরনে আপত্তি জানিয়ে এই চিঠি দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এখন পর্যন্ত সবার জন্য সমান সুযোগ রয়েছে। অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, এবারও উঠবে না।’ সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা পরিবর্তন প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে একটা ভুল বোঝাবুঝি হলেও তাতে কমিশনের সিদ্ধান্ত কিন্তু বদলায়নি। আমাদের যেটা ভুল হয়েছে, তা হলো প্রথম চিঠিতে সেনাবাহিনীর অবস্থান বলে দেওয়া হয়নি। সংশোধিত চিঠিতে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে।’ তবে এ প্রসঙ্গে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েন করার অর্থ বেসামরিক প্রশাসনের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করা। তাই নীতিগতভাবে তিনি এর বিপক্ষে। তবে ইসি বিএনপির দাবির মুখে নিজেই যে ঘূর্ণাবর্তে পড়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করল, তার দায়দায়িত্ব কমিশন-সংশ্লিষ্টদের। আচরণবিধি লঙ্ঘন প্রসঙ্গে কলিমউল্লাহ বলেন, সময় এসেছে এই আচরণবিধি ঠিক করার। এটা করণিক দৃষ্টিভঙ্গিতে করা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান যদি রাস্তায় নেমে ক্রাউড এনজয় করেন, তাহলে সেটি আচরণবিধির লঙ্ঘন হবে না কেন?’ অবশ্য বিএনপি বলছে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন কাজকর্মই প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট, নিজের স্বকীয়তা বলে কিছু নেই। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে দলটি ইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব, সরকারের ইশারায় চলা এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ গতকাল তোপখানা রোডে সাংবাদিকদের বলেছেন, ইসি যে ‘সরকারের ইচ্ছায়’ চলছে, সেনা নিয়ে সিদ্ধান্ত বদলই তার প্রমাণ। বিএনপির পক্ষে শত নাগরিক কমিটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ইসির কাছে যে দাবি পেশ করেছিল, তা মানা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘একটিও মানা হয়নি। আমরা বলেছিলাম ভোটার তার ভোট যাকে ইচ্ছা তাকে যেন দিতে পারে, প্রত্যেক প্রার্থী যেন প্রত্যেক ভোটারের কাছে যেতে পারে, ৫৪ ধারায় আটককৃতদের গ্রেপ্তার না করা, গ্রেপ্তারকৃতদের ছেড়ে দেওয়া, বিভিন্ন মামলায় সন্দেহভাজন আসামিদের গ্রেপ্তার না করা ইত্যাদি। এগুলোর কোনোটিই মানা হয়নি।’ নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার কথা বললেও সাবেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন অবশ্য মনে করেন, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখে তা মনে হয় না। তিনি বলেন, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোটারদের আস্থা কমিশন অর্জন করতে পেরেছে কি না, তার চেয়ে বড় কথা মানুষ এখন আতঙ্কিত। এর কারণ, একটি বড় দলের নেত্রীর ওপর পর পর এমন হামলা সুষ্ঠু নির্বাচনের ইঙ্গিত দেয় না। আরেক প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত বলেন, খালেদা জিয়ার কর্মসূচির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু তার জবাব দিতে হবে ব্যালটের মাধ্যমে, হামলার মাধ্যমে নয়।

No comments:

Post a Comment