Saturday, April 25, 2015

ঘরে-বাইরে নিরাপত্তা নেই শিশুদের:কালের কন্ঠ

গাজীপুরের জয়দেবপুরের ডেকেরচালা এলাকায় থাকত পাঁচ বছরের শহীদুল ইসলাম ইমন। একদিন তার দিকে নজর পড়ে হাসিনা নামের এক নারীর। তিনি ইমনদের বাড়িওয়ালার ছেলে শাকিলের কাছে জানতে চান, শিশুটির (ইমন) বাবা কী করে, কেমন টাকা-পয়সা আছে? শাকিল জানায়, ইমনের বাবা আফতাব উদ্দিন ব্যবসায়ী, বেশ টাকাও আছে। এরপর ইমনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা নেয় চারজন। গত ১৫ মার্চ বিকেলে বাড়ির পাশে মাঠে খেলছিল ইমন। এ সময় হাসিনা ও ত
ার সহযোগী তানিয়া চকোলেট কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে শিশুটিকে অপহরণ করে। এরপর স্থানীয় জয়নাল আবেদীন স্কুলের একটি কক্ষে নিয়ে তাকে আটকে রাখা হয়। পরে হাসিনা শাকিলকে ফোনে বলে, শিশুটিকে অপহরণ করেছি। তুমি ওর বাবাকে বলো ছেলেকে ফেরত পেতে হলে দুই লাখ টাকা দিতে হবে। শাকিল ইমনের বাবাকে ফোনের কথা জানায়। রাতে ইমন মা-বাবার কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে একপর্যায়ে অপহরণকারীরা তাকে গলাটিপে হত্যা করে। পরদিন ট্রাভেল ব্যাগের মধ্যে লাশ ভরে যাত্রীবেশে বাসের মধ্যে রেখে পালিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের পর হাসিনা ও শাকিল আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ইমনকে অপহরণ ও হত্যার এই বর্ণনা দিয়েছে। গত ১৬ মার্চ রাজধানীর বনানীর কাকলী এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ব্যাগের ভেতর থেকে ইমনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় হাসিনা ও শাকিলকে। শাকিল ১৯ মার্চ এবং হাসিনা ২১ মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বনানী থানায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, "দুই লাখ টাকা আদায়ের জন্যই ইমনকে অপহরণের পরিকল্পনা করে হাসিনা। শাকিল ও তানিয়া ছাড়া আরো একজন ছিল চক্রে। তারা 'ঝামেলা' এড়াতে শিশুটিকে মেরে ফেলে। ইমনের বাবার সন্দেহ হলে এবং আমরা তাদের গ্রেপ্তার করায় টাকা আদায়ের কৌশল সফল হয়নি।" শুধু ইমন নয়, তার মতো একের পর এক শিশু অপহরণ ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, গত তিন মাসে ১৭৯ জন অপহৃত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১২৬ জনই শিশু। অপহৃত শিশুদের স্বজন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, সহজেই মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে শিশুদের অপহরণ করা হচ্ছে। এরপর চিনে ফেলায় শিশুদের হত্যা করছে অপহরণকারীরা। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটাচ্ছে পরিচিত ব্যক্তিরা, সংঘবদ্ধ অপরাধীরা নয়। পারিবারিক বিরোধ ও প্রতিহিংসার কারণেও শিশুদের অপহরণ করে হত্যা করা হচ্ছে। পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে ৩৯, ফেব্রুয়ারিতে ৪১ ও মার্চে ৪৬ শিশু অপহরণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য মতে, ২০১৪ সালে অপহৃত হয় ১১৮ শিশু, যার মধ্যে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৬৬ শিশুকে অপহরণের পর উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালে ৪২ শিশু অপহরণের শিকার হয়, যার মধ্যে হত্যা করা হয় ১৩ জনকে। ২০১২ সালে অপহৃত হয়েছিল ৬৭ শিশু। সর্বশেষ গতকাল আশুলিয়ার আড়াগাঁও অপহরণের ১৩ দিন পর রাসেল (১১) নামের এক শিশুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১৬ এপ্রিল অপহরণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের পসরা গ্রামে। অপহৃত হয়েছিল আজম শেখ (১৪)। একই দিন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় সাকিব হাসান (১৫) নামের এক শিশু অপহৃত হয়। আজম স্থানীয় এম এ আজিজ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। বাড়ির পাশেই বৈশাখী মেলায় ঘুরতে গিয়ে অপহৃত হয় সে। এরপর পরিবারের কাছে মোবাইল ফোনে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তবে রাজমিস্ত্রি বাবার পক্ষে অপহরণকারীদের দাবি মেটানো সম্ভব ছিল না। তিন দিন পর স্থানীয় এক পুকুরে পাওয়া যায় আজমের লাশ। এখন পর্যন্ত অপহরণকারীদের শনাক্ত করা যায়নি বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার এসআই শাহ আলম। গত শুক্রবার সকালে গাজীপুরের সাফারি পার্কের শালবন থেকে উদ্ধার করা হয় উল্লাপাড়ার সাকিবের লাশ। সে মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ত। তিন দিন আগে তিন বন্ধু তাকে বেড়ানোর কথা বলে নিয়ে আসে। উল্লাপাড়া থানার ওসি তাজুল হুদা বলেন, ওই তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর সাকিবের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ৬ এপ্রিল গাজীপুরের গজারিবন থেকে ওবায়দুল্লাহ নাবীন (৭) ও নাজমুল হাসান (৫) নামে দুই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৪ এপ্রিল রাজধানীর মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাট এলাকার বাসা থেকে এ দুই শিশুকে অপহরণ করেছিল তাদেরই খালু রুবেল। শুক্রবার ওবায়দুল্লাহদের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, তাদের শ্রমজীবী বাবা শামসুল হক ও মা হেলেনা খাতুন সন্তানের শোকে এখনো বিলাপ করছেন। শামসুল হক জানান, হেলেনার বোন ঝরনা ও তাঁর স্বামী রুবেল আগে তাঁদের সঙ্গে থাকতেন। সম্প্রতি ওই দম্পতির মধ্যে ঝগড়া হয়। এরপর রুবেলকে তাঁরা বাসা থেকে বের করে দেন। রুবেল 'প্রতিশোধ' নিতেই নাবীন ও নাজমুলকে অপহরণ করে হত্যা করেছে। বাড্ডা থানার ওসি এম এ জলিল বলেন, 'আমরা রুবেলকে ধরার চেষ্টা করছি।' গত ২০ মার্চ রাতে রাজধানীর মানিকদি এলাকায় একটি গর্ত থেকে মোসকান নামে চার বছরের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন বিকেল থেকে নিখোঁজ ছিল শিশুটি। মোসকানের বাবা ইকবাল ঢালী বলেন, 'ওর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।' ক্যান্টনমেন্ট থানার এসআই অহিদুল মিয়া বলেন, ময়নাতদন্তে হত্যার মোটিভ এলে হত্যা মামলা হবে। পরিবার কিছু বলতে পারছে না। ১৪ মার্চ রাতে সিলেট নগরের রায়নগর থেকে স্কুলছাত্র আবু সাঈদের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয় এক পুলিশ সদস্যের বাড়ি থেকে। চার দিন আগে অপহরণের পর চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সাঈদের পরিবারের কাছে মোবাইল ফোনে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছিল। তবে চিনে ফেলায় শিশুটিকে হত্যা করে অপহরণকারীরা। গত ৮ মার্চ পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ কলাবাগান বস্তির বাসা থেকে নিখোঁজ হয়েছিল হাসান নামে পাঁচ বছরের আরেক শিশু। ১১ মার্চ বাউনিয়া বাঁধের ডোবায় কচুরিপানার মধ্যে তার লাশ পাওয়া যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে অপহরণের পরদিন চার বছরের শিশু সুমনের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৪ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সফিপুর পূর্বপাড়ার আট বছরের শিশু মোস্তফা কামাল অপহৃত হয়। ১৯ জানুয়ারি তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মুক্তিপণের পাঁচ লাখ টাকা না পেয়েই দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করেছে বলে দাবি স্বজনদের। ১৯ জানুয়ারি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় আবদুর রহিম উল্লাস (৮) নামের আরেক শিশুকে হত্যা করে অপহরণকারীরা। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস শহীদ মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে শিশু অপহরণ ও হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। অল্প সময়ে বেশ কিছু টাকা পাওয়ার লোভ এবং প্রতিহিংসার কারণেই এমনটা ঘটছে। এটি সামাজিক অপরাধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিতরাই শিশুদের বিপদের কারণ।' তিনি আরো বলেন, আইনের প্রতি আস্থা কমছে। অপরাধীরা দেখছে অন্যায় করেও পার পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা উচিত। প্রধান কাজটি পুলিশ প্রশাসনের। জনগণকেও এগিয়ে আসা উচিত।' গোয়েন্দা পুলিশের অপহরণ প্রতিরোধ স্কোয়াডের সদস্য জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) এস এম নাজমুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মূলত আমরা টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে তদন্তে সহায়তা করি। শিশু অপহরণে ঘনিষ্ঠ বা স্বজনরাই বেশি জড়িত থাকে।'

No comments:

Post a Comment