একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়েছে। গতকাল শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মিত স্থায়ী ফাঁসির মঞ্চে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দণ্ড কার্যকর করার ব্যাপারে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্
জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সূত্র জানায়, রাতেই লাশ র্যা ব-পুলিশের পাহারায় অ্যাম্বুলেন্সে করে শেরপুরে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হবে। কারাগার সূত্র জানিয়েছে, ফাঁসি দেওয়ার পর নিয়মানুযায়ী, কামারুজ্জামানের দেহ প্রায় ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর কিছু প্রক্রিয়া শেষে কারাগারের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ফাঁসি কার্যকরের সময় উপ-কারা মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার, ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী, কারাধ্যক্ষ নেছার উদ্দিন, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, র্যা বের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম এবং দুজন কারা চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন। একজন কর্মকর্তা জানান, সব কর্মকর্তাকে মুঠোফোন ফটকে রেখে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, সন্ধ্যা সাতটার দিকে কামারুজ্জামানকে রাতের খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কিছুই খাননি। এরপর একজন কারারক্ষী তাঁকে গোসল করতে বলেন। তিনি গোসল সেরে নিজের সেলে নামাজ আদায় করেন। রাত ১০টার আগে কারা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মনির হোসেন তাঁকে তওবা পড়ান। ফাঁসি দেওয়ার প্রক্রিয়ার সময় ভেতরে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রাত ১০টার পরে দুজন জল্লাদ কামারুজ্জামানের সেলে যান। এ সময় তিনি নামাজে ছিলেন। নামাজ শেষ করার পর তাঁরা পিছমোড়া করে তাঁর হাত বেঁধে ফেলেন। একজন জল্লাদ কালো কাপড়ের যমটুপি পরিয়ে দেন। এ সময় তিনি নির্বাক ছিলেন। জল্লাদেরা যমটুপি পরিয়ে তাঁকে সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের নিয়ে আসেন। মঞ্চে ওঠার আগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না কর্মকর্তারা দেখে নেন। রাত সাড়ে ১০টার কিছু আগে তাঁকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয়। ঠিক সাড়ে ১০টার সময় হাতে থাকা লাল রুমাল ফেলে সংকেত দেন কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির মঞ্চের লিভার টেনে ধরেন জল্লাদ। এতে ফাঁসি কার্যকর হয়ে যায়। কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে গতকাল সকাল থেকেই নানা তৎপরতা শুরু করে কারা প্রশাসন। কয়েক দফা বৈঠকের পর সময় ঠিক করা হয় রাত সাড়ে ১০টা। সেই অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই কারাগারে আসতে থাকেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সন্ধ্যার আগে একটি ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্স কারাগারে ঢোকানো হয়। রাত নয়টার কিছু আগে কারাগারে আসেন ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। এরপর যান ঢাকার সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি। রাত নয়টার কিছু আগে কারা ফটকের আর্চওয়ে স্ক্যানার যন্ত্রটি পরিবর্তন করে র্যা বের আনা অত্যাধুনিক একটি স্ক্যানার বসানো হয়। এর আগে সন্ধ্যা থেকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন সড়কমুখী সব কটি পথ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া ওই সড়কে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আশপাশের ভবনগুলোর ছাদেও পুলিশ মোতায়েন করা হয়। গতকাল বিকেল চারটার দিকে কামারুজ্জামানের সঙ্গে শেষ দেখা করতে তাঁর পরিবারের ১৬ সদস্য কারাগারে আসেন। দুটি মাইক্রোবাসে করে আসা কামারুজ্জামানের স্ত্রী, তিন ছেলে, মেয়ে ও স্বজনেরা প্রায় সোয়া ঘণ্টা কথা বলেন। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তাঁর বড় ছেলে হাসান ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর বাবা স্বাভাবিক ও শান্ত আছেন। তিনি বেইমান-মুশরিকদের কাছে ক্ষমা চাইবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি জান দেওয়া বা নেওয়ার কেউ নন। তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া যায় না।’ দুজন ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে গিয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি দাবি করে তিনি বলেন, ‘সরকার নিজের স্বার্থে ফাঁসির নামে সময়ক্ষেপণ করেছে।’ ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর কারাগারের ভেতরে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এরপর লাশের গোসল করানো হয়। কাফন পরিয়ে লাশটি কফিনে ভরে গাড়িতে তোলা হয়। মৃতদেহ কারাগার থেকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী। এর পরই লাশবাহী গাড়ি কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রায় পৌনে চার বছরের আইনি লড়াই শেষে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম ফাঁসি কার্যকর করা হয় জামায়াতের আরেক নেতা কাদের মোল্লার। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকরের এটি দ্বিতীয় ঘটনা। একাত্তরে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে ১২০ জনকে হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে আসামিপক্ষ। গত বছরের ৩ নভেম্বর সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডের দায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে ৫ মার্চ তা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন কামারুজ্জামান। এরপর ৬ এপ্রিল পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করেন আপিল বিভাগ। ৮ এপ্রিল পুনর্বিবেচনার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই দিনই রায়ের অনুলিপি কারাগারে পাঠানো হয়। ওই দিনই কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে রায় পড়ে শোনায়। এরপর তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না। কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদন জানাননি। একাত্তরে কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদরের প্রধান সংগঠক ছিলেন এবং তিনি আলবদরের গঠন, বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রভৃতি বিষয়গুলো সমন্বয় করতেন। সোহাগপুর গ্রামে হত্যাযজ্ঞ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল তাঁর রায়ে বলেছিলেন, এ হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণের ঘটনাটি চরম হিংস্র প্রকৃতির। ওই ঘটনা এমনই পাশবিক প্রকৃতির, যেখানে শতাধিক নিরস্ত্র মানুষ তাঁদের জীবন ও সম্মান রক্ষা করতে পারেননি, মানবতাবোধের প্রতি ন্যূনতম মর্যাদা সেখানে দেখানো হয়নি। আসামি তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে তাঁর অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছেন। ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায়: আপিল বিভাগে বিচারাধীন মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতের আমির মুজাহিদ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুস সুবহান জামায়াতের নায়েবে আমির আজহারুল জামায়াতের সহ. সেক্রেটারি জেনারেল মীর কাসেম জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সাকা চৌধুরী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সৈয়দ মো. কায়সার জাতীয় পার্টির নেতা মোবারক হোসেন সাবেক আ.লীগ নেতা
No comments:
Post a Comment