Tuesday, April 28, 2015

অনেক প্রশ্নের জবাব আজ:কালের কন্ঠ

মোগল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট নুরুদ্দীন মহম্মদ সেলিম বা সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে তাঁর সুবেদার ইসলাম খান ১৬১০ সালে ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। শহর হিসেবে ঢাকার গোড়াপত্তন মূলত তখন থেকেই। এরপর চার শতকের ইতিহাসে মোগলরা বিদায় নিয়েছে, ব্রিটিশরা এসেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে- যুগে যুগে শহর রূপ বদলেছে, বিস্তৃত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্প-বাণিজ্য ও সংস্কৃতিতে ঢাকা পরিণত হয়েছে এশিয়ার অন্
যতম প্রধান জনপদে। জনসংখ্যার ঘনত্বে এখন বিশ্বে এক নম্বরে এ মহানগরী। বসবাসে অযোগ্যতার তালিকায়ও ঢাকার স্থান সবার ওপরে। সেই মহানগরীতে আজ ১৩ বছর পর তৃতীয় দফা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যাতে ভোট দেবে প্রায় ৪২ লাখ ভোটার। এক কোটি ৬৬ লাখ মানুষকে নাগরিক সেবা দিতে নির্বাচিত হবেন দুজন মেয়র। নোংরা শহরে যানজট-জলজট আর মশার কামড়ে নিত্য ভোগান্তিতে থাকা মানুষও দীর্ঘ সময় পরে সুযোগ পেয়েছে রায় দেওয়ার। একই সঙ্গে নির্বাচন হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও। এবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেবল মেয়র বা কাউন্সিলর বেছে নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর মাধ্যমে ফয়সালা হবে অনেক কিছুর। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনে যাচাই হবে দুই দলের জনপ্রিয়তাও। আগামীর রাজনীতি কোন দিকে যাবে- তা অনেকটা নির্ভর করছে আজকের নির্বাচনের ওপর। ফলে কাগজে-কলমে নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও আজ পরীক্ষায় বসছে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সেই সঙ্গে পরীক্ষা নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আসেননি। তবে এবারের নির্বাচনের ওপর নজর থাকবে তাঁদের। পাশাপাশি জাতিসংঘসহ বিদেশি দূতাবাসের কর্তারাও চোখ রাখবেন সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। গত ৫ জানুয়ারি সরকারের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে বিএনপির আন্দোলনের ডাক ও ৯২ দিনের অবরোধে নজিরবিহীন পেট্রলবোমা হামলা দেখেছে দেশবাসী। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অবস্থানও এ দেশের মানুষের কাছে নতুন। এর মধ্যে সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে সেই পরিস্থিতি থেকে একটি 'এক্সিট রুট' তৈরি করেছে। বিএনপি শুরু থেকেই বলছে, এ নির্বাচন তাদের আন্দোলনের অংশ। খালেদা জিয়া এরই মধ্যে ঢাকাবাসীকে 'বদলা নেওয়ার' আহ্বান জানিয়েছেন ব্যালটের মাধ্যমে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, 'মানুষ পোড়ানোয়' বিএনপিকে ভোট দেবে না ঢাকাবাসী। যদিও আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচন আলাদা। কিন্তু আওয়ামী লীগের তরফে নির্বাচন জয়ের জন্য সর্বাধিক চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন মাসের সংঘাত-পরবর্তী সময়ে এ নির্বাচন হবে দুই দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের নির্বাচন। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন ছিল এযাবৎকালের সবচেয়ে কম বিতর্কিত নির্বাচন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও তেমন সমালোচনা করার সুযোগ পায়নি বিরোধীরা। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আরো বিতর্কে পড়েছে উপজেলা নির্বাচনে। সেই নির্বাচন কমিশনের সামনে আজ পরীক্ষা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে। এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্ভব কি না- এ প্রশ্নের উত্তরও খোঁজা হবে আজ। ২০০২ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার পর মেয়র সাদেক হোসেন খোকা পাঁচ বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন ৯ বছর। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশন ভেঙে দুই ভাগ করা হয়, বিদায় নিতে হয় খোকাকে। করপোরেশনে বসেন দুজন প্রশাসক। তিন মাসের জায়গায় প্রায় সাড়ে তিন বছর চলল তাঁদের শাসন। প্রশাসক বদল হলো কয়েক দফা। তাঁরা সেবাকে নগরবাসীর দুয়ারে নেওয়ার বদলে আরো দূরে নিয়ে গিয়েছিলেন। অল্প সময়ের জন্য প্রশাসক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের প্রতি দায় ছিল না, ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহিতা ছিল না। কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের অনেকেই ছিলেন পলাতক। ফলে নগরীতে কার্যকর কোনো প্রশাসন ছিল না। দীর্ঘ সময় পর অচলাবস্থার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এবার প্রতিযোগিতায় সামনের সারিতে থাকা প্রার্থীরা নিরাপদ, মানবিক, আধুনিক, পরিচ্ছন্ন, আদর্শ ইত্যাদি বহু অভিধার ঢাকা গড়ে তোলার কথা বলেছেন। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে শুধু দুই দলের ছয়জন প্রার্থীর মধ্যে লড়াই সীমাবদ্ধ নেই। ঢাকায় ৩৬ জনের মধ্যে অন্তত ছয়-সাতজন মেয়র পদপ্রার্থী প্রচার চালিয়েছেন সমানতালে। ফলে এ নির্বাচন হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক। তিনি সিটিতে ৪৮ জন মেয়র পদপ্রার্থী, ২৪৮ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর ও ৮৮৪ জন সাধারণ কাউন্সিলরসহ মোট এক হাজার ১৮০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সংকটে পড়ে প্রার্থীদের মুলা, মিষ্টি কুমড়ার মতো অদ্ভুত সব প্রতীক দিতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। এতসব প্রার্থীর মধ্যে মেয়র ও কাউন্সিলর হিসেবে নগরবাসীর কাকে পছন্দ- এ প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে আজ রাতে। সিটি নির্বাচনের প্রার্থীদের জমজমাট প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে গত রবিবার মধ্যরাতে। গত ১৯ দিনের প্রচারণায় দক্ষিণে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ও উত্তরের সাড়ে ২৩ লাখ ভোটারের প্রত্যেকের কাছে ভোট চাওয়া প্রার্থীদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। কিন্তু কর্মী, সমর্থক, ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট, বিজ্ঞাপন, টক শো- সম্ভাব্য সব উপায়ে তাঁরা ভোটারের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে গত ১৯ দিন ভোটের প্রচারে সরব ছিল রাজধানী ও চট্টগ্রাম। প্রচারে এবার নতুন মাত্রাও দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'ফ্যান পেজ' খুলে প্রচারণা চলেছে। মূল পত্রিকা ও অনলাইন পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোট চাইতে দেখা গেছে প্রার্থীদের। কেউ কেউ রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে, কেউ বা দলবল নিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে ভোটের প্রচার করেন- যা আগে দেখা যায়নি। প্রচারণার সময় বেশ কিছু আলোচিত ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চার দিন প্রচারণা চালাতে মাঠে নেমেছেন। এ সময় তাঁকে কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয়েছে। সেটাকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। শনিবার রাতে মাহী বি চৌধুরীর ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে। হামলা হয়েছে আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতনের ওপরও। মেয়র পদপ্রার্থী হয়েও পুরো সময় আত্মগোপনে থেকেছেন মির্জা আব্বাস। শেষ কয়েক দিন আফরোজা আব্বাস ও তাবিথ আউয়াল বারবার নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের ধরে নেওয়া, প্রচারণায় বাধা দেওয়া ও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ করেছেন। ফলে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা আছে। সে শঙ্কা আরো বাড়িয়েছে ভোটের দিন মাঠে সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতি। অবশ্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত থাকবে, ম্যাজিস্ট্রেটরা ডাকলেই তারা বের হবে। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তিন সিটিতে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রায় ৮২ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে, যা অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে বেশি। ফলে ভোট নিয়ে নানা অভিযোগ তোলা বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল, নাকি সত্যি- তাও জানা যাবে আজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনেক কিছুর নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি যদি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিত তাহলে এটি হতো না। তিনি বলেন, বিএনপি এই নির্বাচনকে 'সেলিং পয়েন্ট' হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করবে। তারা জয়ী হলে বলবে, তাদের প্রতি জনসমর্থন বেশি। তাদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি সঠিক। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে তাদের সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও রাজনীতিবিদরা এটিকে একটি বৃহত্তর ক্যানভাসে দাঁড় করিয়েছেন। এটি জাতীয় নির্বাচনের 'প্রক্সি' হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এক অর্থে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন ও তিন মাস ধরে চলা পেট্রলবোমা হামলার পর জনপ্রিয়তা কোন দিকে গেছে এর মাপকাঠি এই নির্বাচন। দুর্ভাগ্যবশত রাজনীতিবিদরা কার পাল্লা ভারী তা যাচাইয়ের নির্বাচনে পরিণত করে ফেলেছেন সিটি নির্বাচনকে। নির্বাচন কমিশনের জন্য এ নির্বাচনকে অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে উল্লেখ করে সুজন সম্পাদক বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এটা তার বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার পরীক্ষা। দলীয় বিবেচনার বাইরে প্রার্থী বা তাঁর ইশতেহার কতটুকু গুরুত্ব পাবে ভোটারের কাছে- জানতে চাইলে ড. আখতার হোসেন বলেন, প্রথমবারের মতো ভোটার হওয়া ৩২ শতাংশের বাইরে বাকিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে 'কমিটেড' থাকে। নতুন ভোটাররা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, তিন মাসের পেট্রলবোমা হামলা, প্রার্থীর ভাবমূর্তি ইত্যাদি বিবেচনা করবে। এ ক্ষেত্রে ইশতেহারের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে প্রার্থীর ভাবমূর্তি। তবে দলীয় বিবেচনাই বড়। ভোটাররা কী বিবেচনায় নিল সে-সংক্রান্ত মোটা দাগের তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে আজ- ১. ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও তিন মাসের সহিংসতার পর কোন দলের জনপ্রিয়তা বেশি? ২. বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না? ৩. মেয়র হিসেবে কোন প্রার্থীর ওপর আস্থা ঢাকাবাসীর? আজ দিনভর নানা ঘটনায় হয়তো প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর মিলবে। তবে শেষ প্রশ্নটির উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হতে পারে মধ্যরাত পর্যন্ত।

No comments:

Post a Comment